তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্র: গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মুখোমুখি চীন

0

চীনের উত্থান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এগুলোর মধ্যে প্রধান সিদ্ধান্ত হল- গণতান্ত্রিক, পশ্চিমাপন্থী ও ২ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার দ্বীপ তাইওয়ানের ওপর হামলা চালিয়ে তা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণের আনা হবে কিনা। যদি কোনো একদিন, একটি অস্ত্রবাহী লাল পতাকার লিমোজিন গাড়িতে করে শি জিনপিং দ্বীপটির রাজধানী তাইপেইয়ের রাস্তায় বিজয়ীর বেশে চলেন তাহলে তিনি এক অমর সমাজতন্ত্রীতে পরিণত হবেন। তিনি তাহলে চীনের গৃহযুদ্ধে মাও সে তুং এর সঙ্গে সহ-বিজয়ী হিসেবে যোগ দেবেন। ১৯৪৯ সালের সেই যুদ্ধ নিষ্পন্ন না হয়েই শেষ হয় এবং চীনের জাতীয়তাবাদী ক্ষমতাসীনরা নির্বাসনের জন্য তাইওয়ানে পালিয়ে যায়।

শি জিনপিং তাইপেইয়ের যে রাস্তা দিয়ে যাবেন তা হয়তো আগুনে ঝলসে যাওয়া, রক্তস্নাত হবে আর স্বৈরাচারী সামরিক শাসনে পীড়িত তাইওয়ানিজরা সে রাস্তা ফাঁকা করে দেবেন। তবে তাইওয়ান জয় করলে চীনের ক্ষমতার উচ্চতা এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে, কোনো দেশ চীনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে কখনো আর সাহস পাবে না। চীনের কঠোর শাসকরা মনে করেন, ইতিহাস খুঁতখুঁতে লোকদের দ্বারা লেখা হয় না। শি জিনপিং যদি চীনের সেনাবাহীনিকে তাইওয়ান দখলের নির্দেশ দেন, তাহলে সব কিছুর উপরে তিনি কেবল একটি বিষয় নিয়েই ভাববেন, আর তা হল- আমেরিকা তাকে থামাতে পারবে কিনা। গত ৭১ বছর ধরে স্ব-শাসিত তাইওয়ানের অস্তিত্ব টিকে আছে চীনের আক্রমণ আমেরিকা দ্বারা প্রতিরোধ করা হবে কিনা তার ওপরে। তবে চীনের ধৈর্য্যের কারণে তাইওয়ান উপকৃতও হয়েছে, কারণ চীনের অন্য পরিকল্পনাও রয়েছে যেগুলোর দ্বারা হয়তো যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব।

চীনের সাবেক সর্বোচ্চ নেতা ডেং জিয়াওপিংয়ের সময়কাল থেকে দেশটির নেতারা তাইওয়ানকে অর্থনৈতিকভাবে চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে একত্রিত করতে চাচ্ছেন। চীন তাইওয়ানের জনগণকে স্বায়ত্বশাসন দেয়ার প্রস্তাবও করেছে যেখানে তারা বেইজিংয়ের অধীনে ‘এক দেশ দুই পদ্ধতি’র আওতায় থাকবে। তবে গত বছর হংকং এর নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণের মাধ্যমে তাইওয়ানে ‘এক দেশ দুই পদ্ধতি’র ধারণা ভেস্তে যায়। কিন্তু চীন ‘শান্তিপূর্ণ একত্রীকরণ’ এর ব্যাপারে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে, আর এক্ষেত্রে অধিকতর শীতল হিসাবগুলো সবসময় বড় ভূমিকা রেখেছে। একেবারে মূল কারণ এই যে, চীন তাদের হাত এই ভয়ে দূরে রেখেছে কারণ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ধারকারীরা পৌঁছানো পর্যন্ত তাইওয়ানের সামরিক বাহিনী প্রতিরোধ ধরে রাখতে পারবে।

এই পরিস্থিতির বিষয়ে আমেরিকার অবস্থান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার পররাষ্ট্র নীতির সহযোগিদের কাছে সুপরিচিত এবং তারা এ ব্যাপারে আগে থেকেই অভিজ্ঞ। এজন্যই বাইডেন প্রশাসন অফিস শুরু করার চতুর্থ দিনেই স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাইওয়ানের অপর চীনের সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে এবং তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি ‘পাথরের মতো শক্ত’ বলে ঘোষণা দিয়েছে।

বাস্তবে তাইওয়ানের ওপর চীনের আক্রমণ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। এর প্রধান কারণ, সাগরে আমেরিকার বাহিনীকে দূরে রাখতে চীনের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা, এবং গত বিশ বছর ধরে এ বিষয়ে চীনের একাগ্র মনোযোগ। আরেকটি কারণ হল, ঐতিহাসিক উদ্দেশ্য সাধনে শি জিনপিংয়ের জ্ঞান এবং নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী ধারণা ব্যবহার করা। ট্রাম্প প্রশাসন যখন তাইওয়ানের কাছে ১৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছিল তখন মার্কিন স্কলার ও অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এর প্রশংসা করেছিলেন। তবে চীনকে উসকানি দিতে ট্রাম্প তাইওয়ানের প্রতি যে লোক দেখানো সমর্থন দেখাচ্ছে এবং এর ফলে তাইওয়ান যে ঝুঁকির মুখে পড়ছে সে বিষয়ে ট্রাম্প চিন্তা না করায় তার সমালোচনা করেন তারা। কাউন্সিল অব ফরেইন রিলেশনের (সিএফআর) রিচার্ড হাসের মতো কিছু স্কলার-কূটনীতিকরা ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ দূর করতে আমেরিকার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ এর ফলে তাইওয়ানের ওপর আক্রমণ হলে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নেবে সে ব্যাপারে প্রকাশ্যভাবে প্রতিশ্রুতি দেয়া এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই অস্পষ্টতা তাইওয়ানের রাজনীতিকদের দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নিতে অনুৎসাহিত করে এবং চীনকে ক্রুদ্ধ করা থেকে বিরত রাখে।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের চীন ও তাইওয়ানের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং ওয়াশিংটনের অন্যতম থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক বনি গ্ল্যাসার বলেন, চীন তাইওয়ান প্রসঙ্গে বাইডেন প্রশাসন সমাধান প্রদর্শন করছে, কারণ সম্ভাব্য দুর্ঘটনা ও হিসাবে ভুলের ব্যাপারে তারা খুবই চিন্তিত আছে। এই দুর্ঘটনার উদাহরণ দিতে বলা যেতে পারে, চীন ও তাইওয়ানের বিমান বা জাহাজের মধ্যে সংঘর্ষ বা আজ থেকে পাঁচ বা দশ বছর পরে স্বপ্রণোদিত কোনো সামরিক পদক্ষেপ।

সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের জাতীয়-নিরাপত্তা বিষয়ক সহযোগী এবং সিএফআরের প্রকাশিত ‘যুক্তরাষ্ট, চীন ও তাইওয়ান : যুদ্ধ এড়ানোর একটি কৌশল’ নিবন্ধের সহ-লেখক রবার্ট ব্ল্যাকউইল চান আমেরিকা যেন চীনের ওপর বিশ্বাসযোগ্য, ‘ভূ-অর্থনৈতিক অবরোধ’ দেয় এবং সেইসাথে সামরিক শক্তি প্রদর্শনও অব্যাহত রাখে। তিনি বলেন, আমেরিকা ও তার মিত্ররা যেমন জাপানের উচিত পরিষ্কারভাবে জানানো যে, তাইওয়ানের ওপর আক্রমণ করলে ডলার ভিত্তিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম থেকে চীনকে বাদ দেয়া হয়বে।

চীনকে ক্ষান্ত রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন অংশ হল শক্তিশালী জোট তৈরি করা যা চীনের আক্রমণকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। শীতল যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা দিয়ে এই সমস্যা বোঝা যাবে না। পশ্চিম জার্মানির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটা আমেরিকার ও তার ন্যাটো সহযোগিদের জন্য অন্যতম জাতীয় স্বার্থের বিষয় ছিল। পশ্চিম জার্মানির শহরে সোভিয়েতদের সংশ্লিষ্টতা বন্ধ করতে যুদ্ধের পরিকল্পনাও তাদের ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন অর্থনৈতিকভাবে ছোট শক্তির দেশ ছিল। কিন্তু তাইওয়ানের অস্তীত্বের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের এমন কোনো মাথাব্যথা নেই যে তাদের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অংশীদার চীনকে রাগিয়ে তাইওয়ানের স্বার্থের পক্ষে তারা কাজ করবে।

এদিকে চীনের নেতারা তাদের দেশের ওপর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ কমাতে চেষ্টা করছেন। চীনের বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল কিয়াও লিয়াং গত মে মাসে এক প্রবন্ধে পূর্বাভাস দিয়েছেন, তাইওয়ানের সঙ্গে চীনের যুদ্ধ হলে আমেরিকা ও তার মিত্ররা চীনা আমদানি-রফতানিকারকদের ব্যবহৃত সমুদ্র-পথ বন্ধ করে দিতে পারে। এছাড়া প্রধান বাজারগুলোতেও চীনের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। সারা বিশ্বের ওপর চীনের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমাতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার প্রশংসা করেন জেনারেল কিয়াও। তিনি বলেন, আমেরিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় চীন কতটা শক্তিশালী, সেটিই তাইওয়ান প্রশ্নের জবাব দেবে।

সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com