আল জাজিরার প্রতিবেদন নিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত চায় বিএনপি

0

আলজাজিরার প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই না করেই সরকার প্রতিবেদনটিকে ঢালাও ভাবে ‘মিথ্যা ও বানোয়াট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

গতকাল বুধবার বিকেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, একদিকে সরকার আলজাজিরার পুরো প্রতিবেদনকেই মিথ্যা ও বানোয়াট বলে নাকচ করে দিয়েছে; অপরদিকে দায়সারাভাবে জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক তদন্ত আহ্বানে অনাপত্তি জানিয়ে বলেছে, ‘তদন্ত হতেই পারে, এ ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। সরকারের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে আমরা অবশ্যই তদন্ত করবো। তবে তদন্তের জন্য জাতিসঙ্ঘ সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অনুরোধ জানায়নি।’ আবার অন্যদিকে আলজাজিরার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সেখানে তথ্যগত ভুল আছে, সেগুলো আমরা তুলে ধরবো এবং আমরা মামলা করবো। আমরা সেটার জন্য কাজ করছি।’ অর্থাৎ আলজাজিরার প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই না করেই সরকার প্রতিবেদনটিকে ঢালাও ভাবে ‘মিথ্যা ও বানোয়াট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অথচ সঠিক তথ্যের প্রকাশই হচ্ছে ভুল তথ্যের জবাব। আর অপ্রচার থেকে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের উপায়ও হচ্ছে আসল সত্য তুলে ধরা।

কিন্তু সরকার প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তু উহ্য রেখে খালি তথ্য অথবা প্রান্তিক বিষয়ের উপর ভর করে ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’ প্রকাশ করে চলছে। যদিও তথ্যচিত্রটি সম্প্রচারের আগে অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল যা তারা উপেক্ষা করেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরায় ‘অল দি প্রাইম মিনিস্টার মেন’ শীর্ষক প্রচারিত অনুসন্ধান প্রতিবেদন সম্পর্কে দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীর সাথে আপনারাও নিশ্চয়ই অবগত আছেন। ওই প্রতিবেদনে সরকার প্রধানের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে তথ্য-প্রমাণসহ নানান দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারি সকল প্রতিবাদ বিবৃতিতে প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগসমূহের সুনির্দিষ্ট জবাব না দিয়ে রাজনৈতিক বুলির আড়ালে অভিযোগসমূহকে প্রত্যাখ্যান করে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি জাতিসঙ্ঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকেও অপরাধ আড়ালের ঢাল হিসাবে ব্যাবহার করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিও সরকারের ওইসক বক্তবের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যার দাবি জানিয়েছিল। তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ এবং তার প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদ-বিবৃতিকে জাতিসঙ্ঘ আমলে নিয়ে বলেছে, দুর্নীতির অভিযোগসমূহ গুরুতর এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এর তদন্ত হওয়া উচিত। দুর্নীতির অভিযোগ সংশ্লিষ্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তদন্ত করার আহ্বানের পাশাপাশি জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে, শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট কর্তৃক আলজাজিরার প্রামাণ্যচিত্রে যে ধরনের অত্যন্ত সংবেদনশীল টেলিফোনে আড়িপাতা ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের কথা উঠে এসেছে ওই ধরনের কোনো সরঞ্জাম ব্যবহারের বিষয় জাতিসঙ্ঘের সাথে বাংলাদেশের সম্পাদিত চুক্তিতে নেই। তাছাড়া জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের কোনো কন্টিনজেন্টে এ রকম সরঞ্জাম ব্যবহারও করে না।

জাতিসঙ্ঘের পিসকিপিং-ইন্টেলিজেন্স পলিসি অনুযায়ী কেবলমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় জাতিসঙ্ঘ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় ওই ধরণের যন্ত্রপাতি জাতিসঙ্ঘ ব্যবহার করে থাকে। এবং তাও ‘ফোর্স কমান্ডার’ ব্যবহার হয়ে থাকে কেবলমাত্র জাতিসঙ্ঘের পিসকিপিং-ইন্টেলিজেন্স পলিসির আওতায় জাতিসঙ্ঘের সরাসরি কর্তৃত্বে। সরকার হাঙ্গেরি থেকে আড়িপাতা যন্ত্রপাতি কেনার কথা ইতোমধ্যেই স্বীকার করেছে। তবে বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এমন একটি দেশ থেকে এসকল সরাঞ্জামাদি আমদানির ক্ষেত্রে অপকৌশল অবলম্বনের অভিযোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা সরকারি বিবৃতিসমূহে অনুপস্থিত। অথচ বিষয়টি রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি গুরুতর অভিযোগ।

বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, ইতোমধ্যে সাতটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা যেমন- (হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, দ্য এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাগেইনস্ট টর্চার, দ্য এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস এবং ইলিয়স জাস্টিস) এক যৌথ বিবৃতিতে আলজাজিরার প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগগুলো নিয়ে জাতিসঙ্ঘকে নিজের মতো করে তদন্ত এবং শান্তিরক্ষা মিশনের সাথে জড়িত বাংলাদেশী ইউনিট ও ব্যক্তিদের মানবাধিকারের রেকর্ড নতুন করে যাচাই করার আহ্বান জানিয়েছে। নিজ দেশে সংগঠিত কোনো অনিয়ম আড়াল করার জন্য জাতিসঙ্ঘকে ব্যবহার না করার জন্য ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে এবং সামগ্রিক পর্যালোচনার আগ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি বিষয়ক আলোচনা স্থগিত রাখা উচিৎ বলেও ওই সাতটি সংগঠন জাতিসঙ্ঘকে জানিয়েছে।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব। ২৬ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে গড়ে উঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের অহংকার। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জাতীয় সংকটে অকাতরে কাজ করে যাওয়া দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা বাহিনী সর্বদা জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দুর্নীতি বা নৈতিকতাবিবর্জিত কর্মের কারণে রাষ্ট্রের সংবেদনশীল এই মহান প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া কোনো ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আলজাজিরার প্রতিবেদনে প্রচারিত অভিযোগসমূহে উল্লেখিত অনেক বিষয় নিঃসন্দেহে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। দেশে ও দেশের বাইরে একাধিক দেশে এসব অপরাধ সংগঠিত হওয়ার সংবাদের কারণে উল্লেখিত অভিযোগসমূহ আন্তর্জাতিক ফৌজদারি অপরাধে রূপ লাভ করেছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনের জন্য হাঙ্গেরি থেকে আড়িপাতার যন্ত্রপাতি আমদানির কথা ইতোমধ্যেই স্বীকার করেছে কিন্তু জাতিসঙ্ঘ পরিষ্কার ভাষায় তা নাকচ করে দিয়েছে। এখন জনমনে প্রশ্ন, অবৈধভাবে আমদানিকৃত ওইসব আড়িপাতা ও নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘনের সরঞ্জামাদি কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে? জনশ্রুতি আছে, এসব সরঞ্জাম বিরোধী জনমতকে দমন করার কাজে ব্যবহার করে নাগরিক অধিকার তথা মানবাধিকারের মত সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে চলছে সরকার। যা গণতন্ত্র হত্যা তথা সংবিধান লঙ্ঘনজনিত অপরাধের শামিল।

তিনি আরো বলেন, সেনাবিহিনী তথা প্রতিরক্ষা বাহিনী জাতীয় ঐক্যের গর্বিত প্রতীক। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখা দল-মত-নির্বিশেষে আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। গোপনীয়তা লংঘনে আড়িপাতার সিগন্যাল সরাঞ্জামাদি আমদানির ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘের নাম ব্যবহারের সরকারি ব্যাখ্যা জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক বাতিল হওয়ার পর জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা মিশনের বৃহত্তম অংশীদার হিসেবে ওই দায়িত্বে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতাই এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। এরূপ আশঙ্কার মধ্যেই জাতীয় ঐক্যের প্রতীক আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী তথা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলতে পারে তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা, ভাবমূর্তি এবং প্রাসঙ্গিকতা।

খন্দকার মোশাররফ বলেন, এ চিত্র সুশাসনের অভাবে মানবাধিকার লংঘন তথা দুশাসনের এক বিশাল ক্যানভাসের কেবলই ক্ষুদ্র চিত্র, রাষ্ট্রক্ষমতার চরম অপব্যবহার ও মাফিয়া সংস্কৃতির এক অতি ক্ষুদ্রাংশ, রাষ্ট্রযন্ত্রকে কুক্ষিগত করে ক্ষমতার দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখার ভয়ানক প্রক্রিয়ার এক অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ এবং লাগামহীন সাগরসম দুর্নীতির একটি ‘টিপ অফ দি আইসবার্গ’ মাত্র। দেশের চলমান এই শাসরুদ্ধকর বাস্তবতায় তাই মনে করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি।

তিনি বলেন, মেন্ডেটবিহীন এই অবৈধ সরকার বহু আগেই জনগণ কর্তৃক ঘৃণীত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েও গায়ের জোরে কেবলমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেই ক্ষমতায় টিকে আছে। ফ্যাসিবাদী কায়দায় ক্ষমতা আকড়ে থাকার জন্য গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি, লুণ্ঠন আর সীমাহীন দুর্নীতির এক অভায়ারণ্যে পরিণত করেছে গোটা দেশকে। দেশে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এই দুশাসনের চিত্র জনসমক্ষে আসছে না। এ প্রেক্ষিতেই আলজাজিরার ওই প্রতিবেদন দেশ-বিদেশে সকল মহলকে করে তুলেছে আরো উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত।

এসময় বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, সাতটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জাতিসঙ্ঘকে এ বিষয়ে জাতিসঙ্ঘকে নিজস্ব পদ্ধতিতে যে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপি তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করছে এবং জাতিসঙ্ঘকে তার নিজস্ব পদ্ধতিতে আলজাজিরার প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগের বিষয়ে আশু তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com