মুদ্রাযুদ্ধ: যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীন-রাশিয়া
২০২১ সালকে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের প্রারম্ভিক বছর হিসেবে বিবেচনা করেন অনেক বিশ্লেষক। নতুন পরিস্থিতিতে এই স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে প্রধান প্রতিপক্ষ এককভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকার দেশ রাশিয়া হচ্ছে না । এই ঠাণ্ডা লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হতে যাচ্ছে চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবেলা করতে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে গঠিত হতে যাচ্ছে কৌশলগত জোট।
চীন কেন আমেরিকার প্রতিপক্ষ হতে যাচ্ছে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। এর সরল জবাব সম্ভবত এটি যে, এবারের যুদ্ধ যতটা না সামরিক শক্তি ও সমর প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হতে যাচ্ছে অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য। অর্থনৈতিক শক্তিমত্তা ছাড়া বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া যায় না এ কথা সব সময় সত্যি ছিল। তবে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল কারণ হতে যাচ্ছে সম্ভবত অর্থনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে আধিপত্য বিস্তার।
২০২০ সালের পর চীন তার গুটিয়ে রাখা ডানা চার দিকে বিস্তার করতে শুরু করবে এই বিশ্লেষণ মার্কিন চিন্তক প্রতিষ্ঠানগুলো দশককাল আগে থেকে করে আসছে। ২০২০, ২০২৫, ২০৩০ সালে বিশ্ব অবয়ব কী রূপ নেবে, তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিল (এনআইসি) যে তিনটি বৃহদাকার গবেষণা প্রতিবেদনের সঙ্কলন প্রকাশ করেছে তাতে চীনের ওপর যত বিশ্লেষণ রয়েছে ততটা অন্য কোনো দেশের ওপর ছিল না। আর এসব বিশ্লেষণের মূল মনোযোগ হলো, চীনের অর্থনীতি কিভাবে বিকশিত হচ্ছে, সে বিষয়ে। কোন সময় কিভাবে চীন আমেরিকান অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে বিশ্বের এক নাম্বার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে তার বিশ্লেষণ ছিল এতে।
মাও সেতুং-এর নেতৃত্বাধীন গতানুগতিক সাম্যবাদী অবয়ব থেকে দেং জিয়াও পিং চীনকে মুক্তবাজার ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমন্বয়ের ধারায় এগিয়ে নিয়ে যান। আদর্শবাদিতার চেয়েও শক্তিমত্তা অর্জন মূল লক্ষ্য হয়ে উঠে চীনা অর্থনীতির। দেং-এর নেতৃত্ব চীনকে অর্থনৈতিকভাবে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যায়। বিনিয়োগ আর বাণিজ্যের পথ ধরে পুঁজিতান্ত্রিক প্রথম বিশ্ব থেকে আফ্রো-এশিয়ার তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে পর্যন্ত চীনা অর্থনৈতিক প্রভাবের নেটওয়ার্ক তৈরি হয়।
চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং নেতৃত্বে আসার পর চীনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আধিপত্যকে ভিত্তি করে বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কার্যক্রমও শুরু করেন। আর এটিই হলো, নতুন স্নায়ুযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত তৈরির পটভূমি। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ করা।
এই চ্যালেঞ্জটি করা হয়েছে এক দিকে ব্রেটন উড ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব-অর্থনীতির অংশীদারিত্ব অনুপাতে নীতিনির্ধারণে অংশ দাবির মাধ্যমে। একসময় এই অনুপাতেই সদস্য দেশগুলোর মালিকানা নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনেক উত্থান পতন ও পরিবর্তন এলেও বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা বা মালিকানায় সেভাবে পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলে বিশ্ব-অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক এসব প্রতিষ্ঠানে পাশ্চাত্যের আধিপত্য থেকে যায়। চীন, রাশিয়া এবং উদীয়মান অর্থনীতির আরো কিছু দেশ এই ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে চায়। একই সাথে বিকল্প বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করার ভাবনাও তাদের মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর সংস্কার প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্মত হওয়ার কোনো সঙ্কেত এখনো পর্যন্ত সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বিকল্প প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ব্রিকস ব্যাংক (প্রতিষ্ঠাতা সদস্য- চীন রাশিয়া ভারত ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা) পরে ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ হিসেবে কাজ শুরু করে। আর সেই সাথে ‘এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক’ কার্যক্রম শুরু করার পর সত্যিকারের চ্যালেঞ্জে পড়ে যায় বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো। এখন বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সদস্যদেরকে অগ্রহণযোগ্য শর্ত চাপিয়ে দেয়া হলে বিকল্প হিসেবে তাদের সামনে উপস্থিত থাকে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক।
এর পাশাপাশি আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক সঙ্কেতটি হলো, বিকল্প আন্তর্জাতিক মুদ্রা সৃষ্টির উদ্যোগ। বিশ্বব্যাপী চীন, রাশিয়া, জাপানের মতো কিছু অর্থনীতি আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বা আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক জোট তাদের মুদ্রাগুলোকে আন্তর্জাতিক লেনদেনে মার্কিন ডলারের সমান্তরালভাবে চালু করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এমনকি ডলারের পরিবর্তে স্বর্ণ বা এসডিআর-এর মতো আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম করারও চিন্তাভাবনা রয়েছে তাদের।
২০০৯ এর মার্চ মাসে চীন ও রাশিয়া প্রথম নতুন বৈশ্বিক মুদ্রা তৈরির আহ্বান জানিয়েছিল। তারা চেয়েছিল যে, বিশ্ব একটি রিজার্ভ মুদ্রা তৈরি করবে যা দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল থাকবে। চীন এ সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতি আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য ডলার প্রতিস্থাপনে একটি মুদ্রা বিকাশের আহ্বান জানায়।
এরকম একটি পদক্ষেপ রাশিয়া, চীন এবং ইকুয়েডরের প্রচেষ্টার সমন্বয়ে ‘অ্যান্টি-ডলার জোট’ নামে পরিচিতি লাভ করে। রাশিয়া আর চীন দীর্ঘ দিন ধরে তাদের আন্তঃসীমান্ত লেনদেনে মার্কিন ডলার বাদ দেয়ার জন্য সংস্কারের উপায় সন্ধান করে। এটি ‘ইউরেশিয়ান কৌশল’ নামে পরিচিত রাশিয়ার একটি অর্থনৈতিক ফোরাম গঠনের ধারণার অংশ ছিল । ২০১৪ সালের মে মাসে প্রায় দশ বছর ধরে আলোচনার পরে, উভয় দেশই মার্কিন ডলারের ব্যবহার কমিয়ে আনার পথে বড় একটি পদক্ষেপ নেয়। তখন রাশিয়ার সাথে চীনের প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের ৩০ বছরের প্রাকৃতিক গ্যাস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই জ্বালানি চুক্তির আওতায় লেনদেনে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে জাতীয় মুদ্রা ব্যবহারের ব্যাপারে দু’দেশ একমত হয়।
ইকুয়েডর, কিউবা এবং বলিভিয়াও বিকল্প মুদ্রা এবং অর্থপরিশোধ ব্যবস্থার বিকাশের জন্য বেশ কয়েক দফা উদ্যোগ নেয়। এ ক্ষেত্রে ইকুয়েডরের পদক্ষেপগুলো ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ২০০৮ সালে ইকুয়েডরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে তেহরান একাধিক সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করে।
ইকুয়েডর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে নতুন জাতীয় ডিজিটাল মুদ্রা (এসডিই) বাস্তবায়ন শুরু করে। এর মাধ্যমে যোগ্য ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্ট স্থাপন এবং এই ই-মুদ্রাকে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। ইকুয়েডরের বিদ্যমান ডলারভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা সমর্থন করার জন্য এর ডিজাইন করার সময়, মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেম গ্রহণ না করে বৈদ্যুতিন অর্থের একটি নতুন রূপ তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিছু বিশ্লেষক সন্দেহ করেন যে, এর আসল লক্ষ্য হচ্ছে মার্কিন ডলারের ওপর চাপ সৃষ্টি।
বাণিজ্যচুক্তি এবং করপোরেট ঋণে মার্কিন ডলারকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভবত রাশিয়া ও চীনের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ হলো ব্রাসেলসভিত্তিক সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিনান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (এসডব্লিউআইএফটি) সিস্টেমের একটি কার্যকর বিকল্প গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। ২০১৫ সালের অক্টোবরে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইউয়ান মুদ্রার ক্লিয়ারিং লেনদেনের সুবিধার্থে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে ‘চায়না ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট সিস্টেম (সিআইপিএস)’ চালু করে। এর মাধ্যমে বেইজিং তার মুদ্রাকে আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য উৎসাহিত করে। একইভাবে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভিসা এবং মাস্টারকার্ড লেনদেনের জন্য একটি ঘরোয়া ‘সুইট’-এর মতো পেমেন্ট সিস্টেম চালু করে যাতে পাশ্চাত্য আর্থিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে কার্ডগুলো ব্লক করতে না পারে।
দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে চীন ও জাপান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করতে সম্মত হয়। জাপান চায়নিজ বন্ড কেনারও সিদ্ধান্ত নেয়। চীন ও জাপান তাদের মুদ্রার সরাসরি বিনিময়ের মাধ্যমে সংস্থাগুলোর ব্যয় কমানো এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। চীনা এবং জাপানি মুদ্রাকে একে অপরের সাথে সরাসরি রূপান্তরিত করার সুযোগ দেয় এই চুক্তি। এর আগে, উভয় দেশের ব্যবসায়ে কাক্সিক্ষত মুদ্রায় রূপান্তর করার আগে বাড়তি ব্যয় করে ডলার কিনতে হতো।
মার্চ ২০১২ সালে, ‘ব্রিকস’ দেশগুলো একে অপরের সাথে বাণিজ্য করার সময় তাদের নিজস্ব জাতীয় মুদ্রার ব্যবহার নিয়ে আলোচনা শুরু করে। চুক্তির আওতায় পাঁচটি দেশ আন্তঃব্রিকস বাণিজ্য এবং স্থানীয় মুদ্রায় ঋণসুবিধার জন্য দু’টি চুক্তি স্বাক্ষর করে বৃহত্তর অর্থনৈতিক গতি সঞ্চার করে।
ইরান যখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার থেকে দূরে সরে গিয়েছিল তখন সবচেয়ে আক্রমণাত্মক দেশগুলোর একটি ছিল। ইরান মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিন ডলার এড়াতে বার্টার বা পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা, স্থানীয় মুদ্রায় অর্থ প্রদান ইত্যাদি ‘টুলস’ ব্যবহার করে।
এমনকি ইউরোপও আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য ডলারের বিকল্প খুঁজতে সক্রিয় ছিল। বিশেষত বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা এবং একতরফা সিদ্ধান্তের পরে এটি তীব্রতর হয়। সম্ভবত ইউরোপীয় প্রভাবের কারণে আইএমএফ বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলার প্রতিস্থাপনের আহ্বান জানিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। অবশ্য কয়েক বছর ধরে প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইউরো, ইউয়ান বা ইয়েন মার্কিন ডলারের বাস্তবসম্মত বিকল্প হতে পারেনি। কিন্তু এতে ডলারের আধিপত্যের সামনে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারে লেনদেনের সাথে বাড়তি ব্যয় যেমন জড়িত থাকে তেমনিভাবে বিনিময় হারের ঝুঁকিও থাকতে পারে। এক গবেষণা দেখা যায় যে, যদি ডলারের বিনিময় হার বিশ্বের অন্য সব মুদ্রার তুলনায় গড়ে ১.০ শতাংশ হারে বাড়ে তবে এক বছরের মধ্যে বাকি দেশগুলোর মধ্যে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ০.৬ থেকে ০.৮ শতাংশ হ্রাস পায়।
একসময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় শতভাগ আমেরিকান ডলার দিয়ে পরিচালিত হতো। সোভিয়েত আমলে বার্টার বা পণ্য বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমে বিকল্প বাণিজ্য চালু করার উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি তখন সার্বজনীনতা পায়নি। পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি অভিন্ন মুদ্রা ‘ইউরো’ চালু করার পর কিছুটা চাপে পড়ে মার্কিন ডলার। কিন্তু ব্রিটেন তার পাউন্ডকে ধরে রাখা এবং সর্বশেষ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার পর ইউরো আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে বেশ খানিকটা গুরুত্ব হারায়। এখন সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তৈরি করেছে চীন।
বিকল্প বৈশ্বিক বাণিজ্য বিনিময় মুদ্রা তৈরির ব্যাপারে চীন আগে থেকেই বিভিন্ন উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। পুতিনের হাতে রাশিয়ার নেতৃত্ব আসার পরে ইউক্রেনে আক্রমণাত্মক কৌশল নিলে তৎকালীন আমেরিকার ওবামা প্রশাসন রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এরপর বিকল্প মুদ্রা তৈরি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার প্রচেষ্টায় চীন-রাশিয়া কৌশলগত সমঝোতা হয়, যার সাথে যোগ দেয় অবরোধের শিকার হওয়া ইরানের মতো বেশ ক’টি দেশ।
বিকল্প মুদ্রা চালুর উদ্যোক্তা দেশগুলো প্রাথমিকভাবে মার্কিন ডলার ও যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বাণিজ্য প্রক্রিয়া এড়িয়ে যেতে জাতীয় মুদ্রায় বৈদেশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। এই উদ্যোগে চীন, রাশিয়া, ইরান, ভারত এবং ক্ষেত্রবিশেষ তুরস্কের মতো রাষ্ট্রও অংশগ্রহণ করে। এর ফলে মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক আধিপত্যের ব্যাপারে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়।
অতি সাম্প্রতিক একটি খবর হলো- চীন একটি আন্তর্জাতিক ডিজিটাল মুদ্রা তৈরির জন্য কাজ শুরু করেছে। এই প্রচেষ্টায় সমর্থন রয়েছে রাশিয়ারও। ডিজিটাল মুদ্রা এবং ডলারের পরিবর্তে স্বর্ণ রিজার্ভ কার্যকর হলে আমেরিকান ডলার আধিপত্য হারাতে পারে।
আমেরিকার আলোচিত-সমালোচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অতিমাত্রার চীনবিরোধিতার বিষয়টিকে অনেকে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয় হিসেবে ভাবতেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসন দায়িত্বে আসার পর আর সন্দেহ থাকছে না, আমেরিকার চীন নীতি কোনো দল বা ব্যক্তির প্রশাসন সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়। এই নীতি আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি ডকট্রিন বা মতবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর চীনকে প্রতিহত করার আমেরিকান গভীর দৃষ্টিভঙ্গি বা নীতির মূল কারণটি হলো যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের অর্থনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করা।
আমেরিকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক শক্তি রাষ্ট্রিক বৈশিষ্ট্যগত কারণেই ক্ষয়িষ্ণু। প্রযুক্তিতে একক আধিপত্য হারানোর কারণে আমেরিকার বাণিজ্য এখন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও আইটি-নির্ভর হয়ে পড়েছে। সেই সাথে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা ও মুদ্রার নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এর ফলে নতুন পরিস্থিতিতে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারে মূল লক্ষ্য হবে অর্থনীতি ও মুদ্রার প্রভাব ধরে রাখা। যারাই এ ক্ষেত্রে বিকল্প কোনো পথে যেতে চাইবে তারা এ জন্য আমেরিকার নীতি ও পদক্ষেপের লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে। চীন-রাশিয়া ছাড়া স্বাধীন নীতি তৈরিতে সক্রিয় অন্য দেশের সাথেও এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র্রের সঙ্ঘাত সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ২০২১ সাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর বলে মনে হয়।