ভারত-চীন: অন্যের সীমানা অতিক্রমে কে এগিয়ে?
চীন ও ভারতের মধ্যে চলমান সীমান্ত বিরোধে নতুন মোড় এনে ভারতের একজন সিনিয়র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দাবি করেছেন, চীনের চেয়ে ভারত অন্তত পাঁচগুণ বেশিবার সীমান্ত টপকে তাদের দেশের ভেতরে ঢুকেছে।
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিংয়ের এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে – ভারত যে ক্রমাগত সীমান্ত টপকে চীনের ভূখণ্ডের ভেতর ঢুকে থাকে এটা আসলে ‘অজান্তে’ তারই একটা স্বীকারোক্তি।
ভারতের এ ধরনের আচরণের ফলেই সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে বলেও চীন পাল্টা অভিযোগ করেছে।
আর চীন-ভারত সম্পর্কের দিকে নজর রাখা পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সীমান্তে উত্তেজনা নিরসনের জন্য দুই দেশের সামরিক ও কূটনৈতিক স্তরের আলোচনায় যে বিশেষ লাভ হচ্ছে না এই কথাবার্তাতেই তা প্রমাণিত।
ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান ও বর্তমানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য, বিজেপি এমপি জেনারেল ভি কে সিং গত রোববার দক্ষিণ ভারতের মাদুরাইতে গিয়ে যে মন্তব্য করেন – বস্তুত তার জেরেই চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধে নতুন এই বিতর্ক দেখা দেয়।
ভারতীয় ভূখণ্ডের ভেতরে ঢুকে পড়ে চীন নানা ধরনের স্থাপনা তৈরি করছে কি না, সাংবাদিক সম্মেলনে জেনারেল ভি কে সিং-কে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন, চীন যদি ভারতে ঢুকেও থাকে তাহলে ভারত তার অন্তত পাঁচগুণ বেশিবার চীনের ভেতরে ঢুকেছে।
তিনি বলেন, ‘সীমান্তটা ওখানে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত নয়, এবং চীন যেটাকে তাদের ধারণা অনুসারে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি বলে মনে করে, সেটা তারা অতিক্রম করে থাকলে আপনারা জানেনই না আমরাও কতবার সেই সীমানা টপকেছি।’
‘আমরা যেটাকে এলএসি বলে মনে করি, সেটা টপকানোর কথাই বলছি – যদিও ভারত তা কখনো ঘোষণা করেনি, চীনা সংবাদমাধ্যমও তা কভার করেনি।’
‘কিন্তু এটুকু আপনাদের বলতেই পারি, চীন যদি ধরে নিই দশবার এলএসি টপকেছে, তাহলে আমরাও কম করে পঞ্চাশবার সীমানা টপকেছি।’
তার এই মন্তব্যকে প্রায় লুফে নিয়ে পর দিনই চীন প্রতিক্রিয়া দেয়, আসলে ভারতের এই ধরনের ‘ট্রান্সগ্রেসন’ বা সীমান্ত অতিক্রম করার ঘটনাই দুদেশের মধ্যেকার ডি-ফ্যাক্টো সীমান্ত অঞ্চলে উত্তেজনার মূল কারণ।
বেইজিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, ‘ভারতীয় পক্ষ আসলে তাদের অজান্তেই একটা স্বীকারোক্তি করে ফেলেছে।’
তিনি আরো অভিযোগ করেন, ‘চীনা ভূখণ্ড দখল করার চেষ্টায় ভারতীয় সেনারা বহুদিন ধরেই সীমান্ত পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে থাকে এবং সব সময় গন্ডগোল ও সংঘাত বাঁধাতে চায়।’
দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও চীন-বিশেষজ্ঞ ঋত্যুষা তিওয়ারি বিবিসিকে বলছিলেন, ‘এখান থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট – ভারত ও চীনের মধ্যে সামরিক পর্যায়ে যে আলোচনা চলছে ও যার নয় রাউন্ড ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, তাতে কোনো অগ্রগতি একেবারেই হয়নি।’
‘বিতর্কিত এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার বা ডিমিলিটারাইজেশনও সম্ভব হয়নি। তার ওপর যেভাবে খোলাখুলি বড়াই করে পরস্পরের সীমান্ত টপকানোর কথা বলা হচ্ছে, তাতেও বোঝা যাচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে সেটা ঘটার কোনো সম্ভাবনাও নেই।’
তবে বিগত প্রায় চার দশক ধরে ভারত-চীন সীমান্ত মোটামুটি শান্তিপূর্ণ থাকলেও এখন যে বেইজিংয়ের আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী মনোভাব দেখা যাচ্ছে তাতে চীন-মার্কিন বাণিজ্য সংঘাতেরও ছায়া দেখছেন অধ্যাপক তিওয়ারি।
তার কথায়, ‘আসলে আমেরিকা ও চীনের ট্রেড ডিসপিউট এত লম্বা সময় ধরে চলেছে যে সেটাই চীনের পররাষ্ট্রনীতিকে এত একরোখা, এত আগ্রাসী করে তুলেছে।’
‘অনেক বিশেষজ্ঞ এখানে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ব্যক্তিত্বকে দায়ী করেন – কিন্তু আমার ধারণা আঞ্চলিকভাবে চীন এটাই প্রমাণ করতে চায় এখানেও যারা আমেরিকার সাথে স্ট্র্যাটেজিকভাবে ঘনিষ্ঠ, তাদেরও তারা ছেড়ে কথা বলবে না।’
নেপথ্যের কারণটা যা-ই হোক, বাস্তবে তাই এখন এই ধরনের রিপোর্টই আসছে যে অরুণাচল প্রদেশের কয়েক কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে চীন না কি একটা আস্ত গ্রাম বানিয়ে ফেলেছে – উল্টোদিকে ভারতের মন্ত্রী দাবি করছেন তাদের সেনারাও কম করে পঞ্চাশবার চীনা ভূখণ্ডের ভেতরে ঢুকেছে!
সূত্র : বিবিসি