সৌদি-কাতার দ্বন্দ্বের অন্য হিসাব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে সামাজ্যবাদের পতন ও তৃতীয় বিশ্বের স্বাধীনতা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। অন্য দিকে সাম্যবাদী শক্তি ও পুঁজিবাদী শক্তির মধ্যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বাম বা ডান কোন এক শিবিরে নাম লেখায়। মধ্যপ্রাচ্য ও ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু সৌদিরা মার্কিন পক্ষ বেছে নেয়। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাজতান্ত্রিক দেশগুলোও মোটের উপর একই পন্থা অবলম্বন করে। কিন্তু ১৯৫২ সালে মিশরে পশ্চিমা সমর্থক রাজতন্ত্রের পতনের মাধ্যমে এক বামপন্থী আরববাদী রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ক্রমে ইরাক, সিরিয়া, দক্ষিণ ইয়েমেন, লিবিয়া, সুদান, আলজেরিয়া, ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন দেশ একই পথ অনুসরণ করে। ক্রমে সোভিয়েত সহায়তা সম্প্রসারিত হয় তাদের দিকে। তখন এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঢেউ ঠেকাতে সৌদি শিবির থেকে ইসলামবাদ প্রচার-প্রসার শুরু হয়।
ফলে শুরু হয় বামপন্থী আরববাদ ও ডানপন্থী ইসলামবাদের এক আঞ্চলিক শীতল যুদ্ধ। কিন্তু ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে সৌদি আরবের সুন্নি ইসলামবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মতাদর্শ শিয়া ইসলামবাদের উৎপত্তি হয়। ফলে সৌদিরা নতুন করে ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষত: ইরানের প্রভাব ছিল সৌদি আরবের নিজের উপসাগরীয় অঞ্চলে। কুয়েতের ৪০%, বাহরাইনের ৭০%, কাতারের ১০%, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ১৫%, ওমানের ৫% এবং খোদ সৌদি আরবের ১৫% শিয়া। এছাড়া ইরাকের ৬৫%, সিরিয়ার ১৫%, ইয়েমেনের ৪৫% শিয়া। পাশাপাশি ওমানের ৭৫% ইবাদি। ফলে ইরানের জন্য যেমন শিয়া সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে সৌদি বিরোধিতা সহজ হয়ে ওঠে, তেমনি নিজ প্রভাব বলয়ের মধ্যে এই বিপুল সংখ্যক সংখ্যালঘু/সংখ্যাগুরু শিয়া সম্প্রদায় সৌদি রাজপরিবারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। ইরানের চক্রান্ত বানচাল করতে সৌদিরা একই বছর গঠন করে ‘গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল’ (জিসিসি)। এর উদ্দেশ্য ছিল তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চলকে অন্তত সম্পূর্ণ ইরান ও শিয়া প্রভাবমুক্ত রাখা।
সৌদি আরব চায়নি অন্তত উপসাগরীয় অঞ্চলে তার প্রভাব ক্ষুণ্ন না হোক। কিন্তু হামাদ ক্ষমতায় আসার পর কাতারের ভোল পাল্টে যায়। হামাদ চাচ্ছিলেন সৌদি প্রভাবকে উপেক্ষা করে কাতারকে তাঁবেদারি রাষ্ট্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রে পরিণত করতে। এরই ফলে ইরানের সাথে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন ও আল-জাজিরা চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় কাতার। এতে সৌদি আরব চরম ক্ষুব্ধ হয়। কাতারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে ২০০২ সালে সৌদি আরব কাতার থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যহার করে। ২০০৮ পর্যন্ত এমন অবস্থা চলে। তাতে অবশ্য কাতারের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কোন নড়চড় হয়নি।
কিন্তু কাতার-সৌদি দ্বন্দ্বে আসলে চরমে ওঠে মুসলিম ব্রাদারহুডকে ঘিরে। ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ইসলামবাদী সংগঠনটিকে পশ্চিমারা বৈশ্বিক সাম্যবাদকে ঠেকাতে ও বিশেষত সৌদি আরব বৈশ্বিক ইসলামবাদ প্রচারে ব্যবহার করেছে বহু বছর। কিন্তু আরব বসন্ত শুরুর পর মুসলিম ব্রাদারহুড নিজ জন্মভূমি মিশরসহ অন্যান্য দেশে সৌদি-সমর্থিত স্বৈরাচারী সরকারগুলোর প্রকাশ্য বিরোধিতা শুরু করলে সৌদিদের টনক নড়ে। তারা ব্রাদারহুডের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং নিজ দেশসহ সর্বত্র তাকে দমন করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। সৌদিদের এই প্রচেষ্টার প্রধান বাধা ছিল কাতার। সৌদি প্রভাববলয়ে থাকার সময় কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডের সহায়কের ভূমিকা পালন করে। কিন্তু হামাদের সৌদি প্রভাব মুক্তকরণ নীতির পরও কাতার ব্রাদারহুডকে পরিত্যাগ তো করেই নি, বরং নিজ পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়ে এসেছে। তাই ব্রাদারহুডের পক্ষেও প্রকাশ্যে সৌদি বিরোধিতা করা সম্ভব হয়েছে। আর কাতারি সহযোগিতায় তুরস্ক ও মিসরসহ অনেক দেশে, বিশেষ করে আরব বসন্তের পর পটপরিবর্তনের সময় প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে আভির্ভূত হয় ব্রাদারহুড। অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি প্রভাব খর্ব করতে ইরান মদদ দেয় আরব বসন্ত এবং মুসলিম ব্রাদারহুডসহ একনায়কতন্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে। আর তাতেই সৌদিদের চক্ষুশূলে পরিণত হয় কাতার।