গৃহকর্মী নির্যাতনে ‘সিদ্ধহস্ত’ ইঞ্জিনিয়ারপত্নী জেসি
দেরিতে ঘুম থেকে ওঠায় গৃহকর্মী সাবিনাকে হত্যার পর মরদেহ লাগেজে ভরে ডোবায় ফেলে দেয়া ইঞ্জিনিয়ারপত্নী জেসির বিরুদ্ধে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ করেছেন আরেক গৃহকর্মী। ২০১৩ সালে বেদেনা (৩৮) নামে ওই গৃহকর্মী সোহাগ-জেসি দম্পতির বাড়িতে তিন হাজার টাকা বেতনে কাজ নিয়েছিলেন।
বেদেনার অভিযোগ- কাজ শুরুর পর থেকেই তার ওপর গৃহকর্তী জেসি নির্মম নির্যাতন শুরু করেন। পরে ২০১৪ সালের ৫ মার্চ মধ্যরাতে তাকে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেন এবং গাড়িচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। তখন প্রাণে বাঁচলেও শরীরের সেই নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন বেদেনা। এখনও সেই নিমর্ম নির্যাতনের কথা মনে হলে আঁতকে উঠেন বলে জানিয়েছেনে বেদেনা।
নির্যাতনের স্বীকার বেদেনা ময়মনসিংহ সদর উপজেলার দেওখলা ইউনিয়নের ইছাইল ব্যাপারীপাড়া গ্রামের খলিলুর রহমানের মেয়ে। বর্তমানে তিনি ময়মনসিংহ নগরের বলাশপুর আবাসন প্রকল্পে বসবাস করেন। শুক্রবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সেখানে খোঁজ নিতে গেলে বেদেনা তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্মম নির্যাতনের কথা জানান।
গৃহকর্মী বেদেনা জানান, বিয়ের পর এক সন্তান জন্ম দেয়ার পর বিভিন্ন কারণে স্বামীর সংসার করতে না পেরে তালাক দেন তিনি। এরপর পেটের দায়ে ২০১১ সালের মাঝামাঝিতে মানুষের বাসায় কাজ করতে শুরু করেন বেদেনা। ২০১৩ সালে বেদেনা প্রতিবেশি মনিকা ও জ্যোতির মাধ্যমে ময়মনসিংহ নগরের ব্যবসায়ী গোলাম সামদানীর মেয়ের বাসায় তিন হাজার টাকায় মাসিক বেতনে গৃহকর্মীর কাজ নেন। জেসির স্বামী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন সোহাগ। এরপর থেকেই বেদেনার ওপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন।
বেদেনার অভিযোগ, মাস শেষে বেতন চাইলে কিংবা বাড়ির লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তার ওপর নেমে আসত নিষ্ঠুর নির্যাতন। জেসি দাবি করতেন- মনিকা ও জ্যোতির কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বেদেনাকে কিনে নিয়েছেন তিনি।
গৃহকর্মী বেদেনা আরও জানান, কাজে টুকিটাকি ভুল হলেই গরম খুন্তির ছ্যাঁকা, ছুরি গরম পেটে ছ্যাঁকা এমকি গরম তেলও ঢেলে দেয়া হতো তার শরীরে। একদিন কাজে ভুল করায় জেসি খাটের ভাঙা কাঠ দিয়ে পিটিয়ে তার বাম হাত ভেঙ্গে দেয়। ওইদিন বেদেনাকে বোরকা পরিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে মধ্যরাতে গাড়িতে করে নগরের ফুলবাড়িয়া সড়কের পশু হাসপাতালের সামনে নির্জন স্থানে চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে বেদেনাকে ফেলে দেয়।
বেদেনা বলেন, গাড়ি থেকে ফেলে দেয়ার পর তাদের আরও দুটি গাড়ি তাকে চাঁপা দিয়ে মারতে চাইলে হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তায় পাশে পড়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান তিনি। পরদিন ভোররাতে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বেদেনাকে উদ্ধার করেন এলাকাবাসী। ৪৬ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হন বেদেনা।
ওই ঘটনায় বেদেনার বাবা খলিল মিয়া বাদী হয়ে ২০১৪ সালের ৮ মে থানায় মামলা করেছিলেন। মামলাটিতে জেসি ও তার স্বামী সোহাগসহ চারজনকে আসামি করা হয়। তদন্ত শেষে ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্রও দেন পুলিশ। তবে জেসি বিভিন্নভাবে চাপ দিলে ২০১৬ সালে মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয় বেদেনার বাবা খলিলুর রহমান।
গৃহকর্মী সাবিনা হত্যার বিষয়টি জানার পর বেদেনা বলেন, ‘মাঝে মারুফা নামে আরেক শিশুগৃহকর্মীকেও নির্যাতন করেছিলেন জেসি। তখন আমি তাকে (জেসি) ভাল হওয়ার জন্য একটি সুযোগ দিয়েছিলাম। মামলাও তুলে নিয়েছিলাম। এবার তার কঠোর শাস্তি চাই।’
গৃহকর্মী সাবিনা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই’র এসআই আবুল কাশেম বলেন, ‘বিষয়টি জেনে খোঁজখবর নিয়েছি। সবগুলো বিষয় মাথায় নিয়েই গৃহকর্মী সাবিনা হত্যা মামলা তদন্তের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।’
জানা গেছে, গত বছরের ৮ নভেম্বর ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় গৃহকর্মী সাবিনাকে (২০) বেধড়ক পিটিয়ে ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করে জেসি ও তার স্বামী। হত্যার পর সাবিনার মরদেহ লাগেজে ভরে রাতে গৌরীপুর গঙ্গাশ্রম এলাকায় জোড়া ব্রিজের নিচে ডোবায় ফেলে দেন। পরদিন সেখান থেকে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
ওই দিন অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে গৌরীপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ। পরে ১৫ নভেম্বর হত্যা মামলা তদন্তের জন্য পিবিআইয়ে হস্তান্তর হয়। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি রাতে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে জেসি ও তার স্বামী জাকিরকে গ্রেফতার করে পিবিআই। পরদিন ২৮ জানুয়ারি আদালতে জেসির স্বামী হত্যার দায় স্বীকার করে। তবে জেসি হত্যার দায় স্বীকার না করায় পুলিশ তাকে তিনদিনের রিমান্ডে নেয়।