মিয়ানমারে কেন এই সামরিক অভ্যুত্থান?
আগামী জুলাই মাসে মিয়ানমার সেনাপ্রধান মিন অং লাইংয়ের বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হবে। আর আইন অনুসারে তখন তার অবসরে যেতে হবে। আর সেটি ঘটার আগেই তিনি অভ্যুত্থান ঘটালেন। কারণ দীর্ঘদিন ধরে তিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন আর পরিকল্পনা করে আসছিলেন। মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মিয়ানমার সেনাপ্রধানের এ উচ্চাভিলাষকে অন্যতম একটি কারণ হিসেবে মনে করছেন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর মেলিসা ক্রাউচ। গত নভেম্বরের নির্বাচনে সেনা সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি-ইউএসডিপির ব্যাপক ভরাডুবির ফলে ব্যর্থ হয়ে যায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মিন অং লাইংয়ের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন।
সেনাবাহিনী রচিত ২০০৮ সালের সংবিধান অনুযায়ী সংসদের ২৫ ভাগ আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেনা সদস্যদের জন্য। সে হিসাবে মিয়ানমার সংসদে সেনাসদস্যদের মোট সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৬৬টি। মিন অং লাইংয়ের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য সংরক্ষিত আসনের বাইরে ইউএসডিপির আরো ১৬৭টি আসনে জয়লাভের দরকার ছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর দলটি সংরক্ষিত আসনের বাইরে জয় পেয়েছে মাত্র ৩৩টি আসনে। সংরক্ষিত আসন ছাড়া ৪৯৮টি আসনের মধ্যে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি-এনএলডি জয় পায় ৩৯৬ আসনে।
সোমবার প্রথমবারের মতো নতুন সংসদ বসার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ক্ষমতা দখল করলেন সেনাপ্রধান মিন অং। আর তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে এটি ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ ছিল না বলে মনে করেন মেলিসা ক্রাউচ।
মিন অং লাইং মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পান ২০১১ সালে। এর আগে সেনাবাহিনীর বাইরে তার নাম তেমন কেউ জানত না। ১৯৬২ সাল থেকে টানা ৪৯ বছর সেনা শাসন শেষে ২০১১ সাল থেকে মিয়ানমারে বেসামরিক শাসনের পালা শুরু হয়।
২০১৫ সালের নির্বাচনে বহু দল অংশগ্রহণ করে এবং সু চির দল এনএলডি জয় লাভ করে। তখন থেকেই সেনাপ্রধান মিন অং নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদের উপযুক্ত প্রার্থী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ২০১৬ সালে তার অবসরে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি অবসরে যাননি। বরং বিচ্ছিন্ন একজন সৈনিক থেকে নিজেকে পাবলিক ফিগারে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন। এর জন্য তিনি বেছে নেন সোশ্যাল মিডিয়া। তার জন্য খোলা হয় একটি ডেডিকেটেড ফেসবুক পেজ। সেখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে তুলে ধরা হয় তার সব কার্যক্রম। সেনাপ্রধানের বিভিন্ন বৌদ্ধ মঠ সফর, তার সাথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাতের সব ছবি ও খবর প্রচার করা হয় ফেসবুক পেজে। এমনকি সেনাবাহিনীর অফিসিয়াল অনেক বক্তব্য বিবৃতিও নিয়মিত প্রচার করা হয় এখানে। এটা হয়ে ওঠে সেনাবাহিনীর এক প্রকার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের মতো। (আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীর বক্তব্য কোট করার ক্ষেত্রে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করতে দেখা গেছে তার ফেসবুক পেজ।) তার একটি ফেসবুক পেজের অনুসারীর সংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ। আর সেনাবাহিনীর বিভিন্ন তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে এটি হলো প্রধান আউটলেট। বিশেষ করে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ পরিচালনার সময় এ ফেসবুক পেজ থেকে সেনাবাহিনীর পক্ষে প্রচারণা চালানো হয়। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, গণধর্ষণ আর জ্বালাও পোড়ায়ের মাধ্যমে সাড়ে সাত লাখ (বাস্তবে ১০ লাখের বেশি) রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পরের বছর ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনীর দু’টি ফেসবুক পেজ বন্ধ করে দেয়।
ইয়াঙ্গুনভিত্তিক ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার নামক ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, রোহিঙ্গা নিধনের কারণে মিন অং লাইং হলো পৃথিবীর একজন মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান।
জাস্টিস ফর মিয়ানমার নামক একটি ক্যাম্পেন গ্রুপ সোমবারের অভ্যুত্থান বিষয়ে বলেছে, এর পেছনে শুধু মিন অং লাইংয়ের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নয় বরং তার সম্পদও একটি কারণ। তিনি তার ব্যক্তিগত স্বার্থে তার পদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছেন। সেনাপ্রধান থাকার সুবাদে মিন অং লাইংয়ের সন্তানেরা রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়িক স্বার্থ আদায় করেছে। সেনাপ্রধান হিসেবে মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন এবং মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেডের ওপর রয়েছে তার একচ্ছত্র প্রভাব। এ দুটি প্রতিষ্ঠান জেমস, কপার, টেলিকম, বস্ত্রসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে।
জাতিসঙ্ঘের তদন্তকারীরা এর আগে এ দুটি সংস্থার ওপর অবরোধ আরোপের আহ্বান জানায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি। কারণ এ ধরনের সংস্থা থেকে আসা বিপুল অর্থ মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনায় সহায়তা করছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বার্মা ক্যাম্পেনের পরিচালক মার্ক ফারমানের মনে করেন, এটা শুধু সামরিক অভ্যুত্থান নয় বরং এর পেছনে রয়েছে সেনাপ্রধানের অবস্থান আর সম্পদ। অনেকের মতে সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থও সোমবারের অভ্যুত্থানের পেছনে ভূমিকা পালন করেছে।
ইউনিভার্সিটি অব নটিংহাম-এর এশিয়া রিসার্স ইনস্টিউটের গবেষক ব্রিজেট ওয়েলশ মনে করেন সু চির দলের ভূমিধস জয়ের ফলে সেনাবাহিনী বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তাদের বারগেনিং পাওয়ার দুর্বল হয়ে পড়েছে। সংসদে সেনাবাহিনীর জন্য ২৫ শতাংশ বা ১৬৬টি অনির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে তারা সংবিধানের যে কোনো সংশোধনীর বিরুদ্ধে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু নভেম্বরের নির্বাচনে সু চির দলের ব্যাপকভিত্তিক জয়ের কারণে তাদের সে ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এটা মিয়ানমারে আর্মির অবস্থান এবং কর্তৃত্বের প্রতি একটি বড় ধরনের হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
তবে অং সান সু চির দল এনএলডির এ ধরনের জয়ের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাপ্রধান কতদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন তা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, নতুন প্রজন্ম এর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে প্রতিবাদে সোচ্চার হবে। মিয়ানমারে এর আগে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষের জীবন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
৮ নভেম্বরের ভোটের ঠিক কয়েক দিন আগে থেকেই জনমনে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে নির্বাচনের ফলাফল নাও মানতে পারেন ক্ষমতাধর সেনাপ্রধান মিন অং লাইং। তার কিছু বক্তব্যে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
ফলে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা উপেক্ষা করে বিপুল জনতা ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছিল প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। মিয়ানমারের রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার আশায়। উৎসাহী আর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভোটাররা মিয়ানমারে সত্যিকারের গণতন্ত্র দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সে আকাঙ্খা সত্যি সত্যিই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে সোমবারের সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।
সূত্র : আলজাজিরা