উজি পিস্তল বিক্রিতে প্রতারণা

0

ফরিদপুর পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মো. সেলিম হাসান। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। তার অস্ত্রের লাইসেন্সে বন্দুক ও পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেলের অনুমতি ছিল। সেই লাইসেন্স নিয়ে তিনি এসেছিলেন ঢাকার মঈন আর্মস কোং নামের একটি অস্ত্র বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে। ওই প্রতিষ্ঠান তার রাইফেলের লাইসেন্সে পয়েন্ট টু টু বোরের উজি পিস্তল বিক্রি করে দিয়েছে। রাইফেলের চেয়ে ছোট এবং সহজে বহন করা যাবে ভেবে সেলিম হাসান উজি পিস্তল কিনে নিয়ে যান। সম্প্রতি দেশে উজি পিস্তল নিয়ে আলোচনা ওঠার পর পুলিশ ও গায়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তার বিষয়ে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করেছেন। না জেনে সেলিম হাসান এখন উজি পিস্তল কিনে শঙ্কায় আছেন।

কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে এই মারণাস্ত্রটি অবৈধ ঘোষণা করা হলে তার পিস্তলটি জব্দ করা হবে।

সেলিম হাসান বলেন, আমার অস্ত্রের লাইসেন্সে বন্দুক আর পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেলের অনুমতি ছিল। লাইসেন্স নিয়ে যখন ঢাকার মঈন আর্মস কোং নামের দোকানে গেলাম তখন অনেক আইটেম দেখানো হলো, সেগুলো নাকি আমার লাইসেন্সের ভেতরে পড়ে। ওই সময় আমাকে উজি পিস্তল দেখিয়ে বলা হয় এটি নতুন আসছে এবং পয়েন্ট টু টু বোরের মধ্যে পড়ে। আমার লাইসেন্স দিয়ে সেটি কেনা যাবে। রাইফেল এতো ছোট হয় আমার জানা ছিল না। সব সময় জেনে আসছি রাইফেল বড় হয়। কিন্তু উজি পিস্তল ছোট দেখে পছন্দ হয়। কারণ এটি বহন করতে সুবিধা হবে। তখন আমি বলি আমার লাইসেন্সে যদি এটা দেয়া যায় তবে দেন। তিনি বলেন, আমিতো অবৈধভাবে কিনিনি। তাই সরকার যদি চায় এটা ফেরত দিতে হবে তাহলে ফেরত দিবো।

ফরিদপুরের সেলিম হাসানের রাইফেলের লাইসেন্সে উজি পিস্তল বিক্রি করা হয়েছিল কি-না জানতে চাইলে অস্ত্র বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মঈন আর্মস কোংয়ের প্রোপ্রাইটর মঈন ইকবাল বলেন, আমরা উজি পিস্তল আমদানি করিনি। উজি রাইফেল আমদানি করেছি। আর রাইফেলের লাইসেন্সে রাইফেল বিক্রি করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, আমরা ৫৩টি উজি পিস্তল যাদের কাছে আছে তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করে তাদের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করছি। ইতিমধ্য সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে কিছু তথ্য পেয়েছি। পাশাপাশি আমরা নিজেরাও কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। তিনি বলেন, ক্রেতাদের কাছে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান উন্নতমানের রাইফেলের কথা বলে উজি পিস্তল বিক্রি করেছে। একজন মাদক ব্যবসায়ীর কাছে সর্বপ্রথম উজি পিস্তল পেয়ে আমরা অধিকতর তদন্ত করে বিস্তর তথ্য পেয়েছি। উজি পিস্তল নিয়ে একটি প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় এটিকে অবৈধ ঘোষণা করলে আমরা সেগুলো জব্দ করবো।

গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ফরিদপুরের সেলিম হাসানের মতো আরো অনেকের কাছে রাইফেলের কথা বলে উজি পিস্তল বিক্রি করা হয়েছে। ক্রেতাদের লাইসেন্সের সঙ্গে অস্ত্রের মিল নেই। আবার কেউ কেউ উজি পিস্তলের ক্ষমতা সম্পর্কে জেনেই কিনেছেন। কারণ পয়েন্ট টু টু বোরের সেমি অটোমেটেড এই পিস্তলটি মিলিটারি গ্রেডের। বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পিস্তলটি ব্যবহার করেন। বেলজিয়ামের আর্মড ফোর্স এবং ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্সে পিস্তলটি বেশি ব্যবহার হয়। অত্যাধুনিক এই পিস্তলে ২০ রাউন্ডের দু’টি ম্যাগাজিন আছে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে এমন ম্যাগাজিনের ধারণ ক্ষমতার অস্ত্র নেই। দেশে সর্বোচ্চ ১৫ রাউন্ড ধারণ ক্ষমতার পিস্তল আছে। উজি পিস্তল ও উজি রাইফেলের স্পেয়ার পার্টস, ওজন ও দৈর্ঘ্য ছাড়া আরো অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে পার্থক্য। বেসামরিক মানুষের কাছে পিস্তলটি থাকার কথা না। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানিয়েছেন, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ১১১টি উজি পিস্তল ও রাইফেল বাংলাদেশে আমদানি করেছে অস্ত্র আমদানিকারক ছয়টি প্রতিষ্ঠান। পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আমদানি করেছে ৯১টি উজি পিস্তল। এর মধ্যে ৪৯টি পিস্তল বিক্রি হয়েছে। আর একটি প্রতিষ্ঠান আমদানি করেছে ২০টি উজি রাইফেল। তার মধ্যে চারটি বিক্রি হয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ৪৯টি উজি পিস্তল ও ৪টি রাইফেলের চল্লিশটিই কিনেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। এর মধ্যে মন্ত্রী থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য ও জেলা পর্যায়ের পদধারী নেতারা রয়েছেন। ১২টি কিনেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। আর একটি কিনেছেন পুলিশের একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর। প্রাথমিকভাবে ৫৩ জন ক্রেতারই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, উজি পিস্তলের ক্রেতা ও ব্যবহারকারীদের তথ্যের জন্য চিঠির মাধ্যমে স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ তাদের সম্পর্কে পজেটিভ রিপোর্ট দিয়েছেন। তবে উজি পিস্তলের ক্রেতারা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন, বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। উজি রাইফেলের কথা বলে তাদের কাছে উজি পিস্তল বিক্রি করা হয়েছে। এই প্রতারণার জন্য অনেক ক্রেতা ওই সব প্রতিষ্ঠানের নামে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো দাবি করছে তারা বৈধভাবেই উজি পিস্তল ও রাইফেল আমদানি করেছেন। আর ক্রেতাদের যে লাইসেন্স আছে সে অনুযায়ী অস্ত্র বিক্রি করা হয়েছে।

উজি রাইফেলের ক্রেতা ও ঢাকার নবাবপুরের ব্যবসায়ী মো. সুলতান মাহমুদ বলেন, আমার রাইফেলের লাইসেন্স দিয়ে আমি উজি রাইফেল কিনেছি। বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার সদস্যরা আমার কাছে এসেছিল। এখন সরকার যদি এটাকে অবৈধ ঘোষণা করে ফেরত দিতে বলে তাহলে আমি দিয়ে দিবো। আর আমি আমার নিজের নিরাপত্তার জন্য এটি চার বছর আগে কিনেছি সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com