লালকেল্লায় নিশান উড়ল বটে, কিন্তু আমরা কি বুঝতে পারছি ভারত কোন পথে?

0

‘লালকিল্লা পর লাল নিশান’। ছোটবেলা থেকে বামপন্থীদের দেওয়া সেই স্লোগানটা মঙ্গলবার দুপুরে লালকেল্লায় ফিরে এল অন্যভাবে। অনেক কিছুর প্রতীক দিল্লির এই দুর্গে পতাকা উড়ল বটে, তবে সেই পতাকা গৈরিক। আসলে আন্দোলনকারী শিখ কৃষকদের পতাকা।

এবং ইতিহাসের ও রাজনীতির কী অদ্ভুত সমাপতন দেখুন, লালকেল্লায় এই পতাকাটা উড়ল ভারতবর্ষের প্রজাতন্ত্র দিবসে।

পতাকাটা গৈরিক হলেও কেন্দ্রের শাসক দলের যে সব সমর্থকরা এই ঘটনাকে ‘ভয়ঙ্কর’ বলে বর্ণনা করছেন, এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ‘গেল গেল’ রব তুলছে, তাঁরা হয়ত ভুলে যাচ্ছেন, ভারতীয়ত্বের প্রতীক, রাজধানী দিল্লির অনেক কিছুর প্রতীক লালকেল্লাটা মুঘলরা বানিয়ে গিয়েছিল।

লালকেল্লাটা আসলে প্রতীকী। মঙ্গলবার প্রজাতন্ত্র দিবসে লালকেল্লায় কৃষকদের ঢুকে পড়াটা যদি অনভিপ্রেত ঘটনা হয়, তাহলে এটাও মাথায় রাখতে হবে, কৃষকদের ক্ষোভ কোন পর্যায়ে গেলে খাস রাজধানী দিল্লিতে এই ধরনের বিক্ষোভ হতে পারে।

এবং দুটোই আসলে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের কাছে ও যে কোনও সরকারের কাছে সমান অস্বস্তিকর। প্রজাতন্ত্র দিবসের বিকেলে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে দিল্লিতে কৃষক বিক্ষোভের খবর দেখতে দেখতে বুঝতে পারছিলাম, গোটা ঘটনাটাই কতটা বিব্রতকর।

কৃষক আন্দোলনের নেতারা যাবতীয় ‘হিংসাত্মক’ আন্দোলনের থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরি করে নিলেও এটা বুঝে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, দিল্লির সীমান্তে গত ৬০ দিন ধরে চলা কৃষকদের বিক্ষোভ এবং আন্দোলন আসলে আমাদের কোন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

মঙ্গলবারের বিক্ষোভ হোক কিংবা গত দুই মাস ধরে চলা কৃষক আন্দোলন, তা কিন্তু আসলে পাঞ্জাবের শিখদের লড়াই। তাই শুধুমাত্র ‘শক্তি’ দিয়ে সেই আন্দোলনকে কতটা দমিয়ে রাখা যাবে, বা দমনের চেষ্টা হলে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তাও বোধহয় ৭২তম প্রজাতন্ত্র দিবস বলে দিয়ে গেল।

১৯২০-র জালিয়ানওয়ালা বাগ থেকে ১৯৮৪-র ‘অপারেশন ব্লু স্টার’, গত একশো বছরের ইতিহাসে পাঞ্জাবের এবং শিখদের অসন্তোষ ও বিক্ষোভ কোনও নতুন কথা নয়। কখনও সেটা ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে আছড়ে পড়েছে, তো কখনও একেবারে গায়ে লাগোয়া প্রতিবেশী, অর্থাৎ দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। শিখদের এই অসন্তোষ রাষ্ট্র বা সমাজের কাছে কখনও কোনও সুখকর বিষয় নয়।

কিন্তু তার কারণ কি বা কীভাবে সেই ক্ষতে প্রলেপ লাগানো যায়, সে বিষয়ে বোধহয় সবসময় সতর্ক এবং সংবেদনশীল থাকতে হয়। শিখ-আবেগ এবং ক্ষোভের জন্য বোধহয় কঙ্গনা রানাওয়াতের টুইট বা অতি ‘রাষ্ট্রবাদী’-দের সোশ্যাল মিডিয়ায় চিৎকার ঠিক দাওয়াই নয়।

আমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এটা জানেন এবং বোঝেন। সেই কারণেই সংস্কারমুখী অর্থনীতির জন্য তিনি বদ্ধপরিকর হলেও কৃষি আইনগুলো বাতিলের দাবিতে শিখদের এই অনমনীয় মনোভাব কেন, সেটাও তিনি উপলব্ধি করতে পারেন।

মঙ্গলবারের প্রজাতন্ত্র দিবসের যাবতীয় আয়োজনকে যে কৃষক বিক্ষোভ পিছনে ঠেলে দিয়েছে, এটাও নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় সরকারের বুদ্ধিমান পরামর্শদাতারা ভালই উপলব্ধি করেছেন। তাহলে অতঃপর কী? কেন্দ্রীয় সরকার অন্তত দেড় বছর কৃষি বিলগুলো স্থগিত রাখার প্রস্তাব ইতিমধ্যেই দিয়েছে।

কিন্তু কৃষক সংগঠনগুলো এত দিন সবকটি বিল বাতিলের দাবিতে অনড় ছিল। দু’পক্ষের এই অবস্থানের মধ্যে কীভাবে রফাসূত্র আবিষ্কৃত হতে পারে, সেটাই বোধহয় এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয়। কারণ হিংসা এবং রক্তপাত কখনই কাম্য হতে পারে না। সেটা সরকার যতটা জানে, কৃষক আন্দোলনের নেতারাও বোঝেন।

মঙ্গলবারের দিল্লির চিত্র হয়ত সবাইকেই ভাবতে বাধ্য করবে কীভাবে শান্তি এবং কৃষকদের স্বার্থ, দুটোকেই রক্ষা করা যায়। রাষ্ট্র অথবা সমাজ কোনও জেদ কিংবা একগুঁয়ে মতের উপর চলতে পারে না। সেটা আসলে অমঙ্গল-ই ডেকে আনে।

বিভিন্ন লেখায় বা আলোচনাসভায় আমি আমার সামান্য বুদ্ধিমতো বারবার বলার চেষ্টা করেছি, ভারতের অন্য যে কোনও আন্দোলনের সঙ্গে পাঞ্জাবের, শিখদের দাবি-দাওয়ার একটা তফাৎ রয়েছে। বিখ্যাত সাংবাদিক এবং পাঞ্জাব বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত শেখর গুপ্ত এই কৃষক আন্দোলনের একেবারে প্রথমে সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে লিখেছিলেন, আসলে শিখরা ‘লড়াই’ করতে ভালোবাসে।

বিশেষ করে যদি তাঁদের ক্রমাগত কোণঠাসা করা হয়, বা চ্যালেঞ্জ করা হয়। ভারতবর্ষের গত একশো বছরের ইতিহাসও তাই বলে। মঙ্গলবারের দিল্লিও সেটাই আবার জানান দিয়ে গেল। আমরা কি শিখবো, কোন পথে এগবো সেটাই ঠিক করে দেবে আগামী দিনে ভারত কতটা শক্তিশালী হবে।

 

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com