দেশে নদী দখলদারের সংখ্যা ৬৩,২৪৯ জন
উচ্ছেদ অভিযানের মধ্যেও সারাদেশে নদী দখলদারের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২০ সালে দেশে নদী দখলদারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ২৪৯ জনে; যা আগের বছর তথা ২০১৯ সালে ছিল ৫৭ হাজার ৩৯০ জন। গতকাল মঙ্গলবার বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এতে জানানো হয়, দেশের প্রতিটি বিভাগেই পেশি শক্তি ও প্রভাব বিস্তার করে নদীর মধ্যে বড় বড় কিছু অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও ওইসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা যায়নি। এমনকি সরকারি স্থাপনাও সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং লজিস্টিক ও অর্থ সংকটের কারণে নদী দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম বাঁধাগ্রস্থ হয় বলে জানানো হয় অনুষ্ঠানে।
রাজধানীর পুরানা পল্টনে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অস্থায়ি কার্যালয়ে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে জুমেও অনেকে যুক্ত হন। নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদারের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান।
সভায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, আমরা ২০১৯ সালের নদী দখলদার ও উচ্ছেদের প্রতিবেদন প্রকাশ করছি। ওই বছর নদীর দখলদার ৫৭ হাজার ৩৯০জন। এর মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ১৮ হাজার ৫৭৯ জনকে; যা নদী দখলকারীর ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ২০২০ সালের তথ্য এখনো পুরোপুরি সংগ্রহ করা হয়নি। এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে যে তথ্য পেয়েছি তাতে সারাদেশের নদী দখলদারের সংখ্যা ৬৩ হাজার ২৪৯ জন। নদী দখলদার চিহ্নিত করার কাজ অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও ধলেশ^রী নদীগুলোর অনেক যায়গা বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করার চিত্র দেখা গেছে। সরকারের নদী রক্ষার চার হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্প শুরু হয়েছে তা বাস্তবায়নে জটিলতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ সেখানে বিদ্যু ও সোলার প্ল্যান্ট, সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসহ অনেক বড় বড় শিল্প কারখানা রয়েছে। যদিও এসব প্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে। তবুও এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নদী দখলের মাত্রা এখন কমেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রী অধ্যাপক এম এ মান্নান বলেন, নদী দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও তাদেরকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিষয়ে যে প্রস্তাব এসেছে তা নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদী উদ্ধারের পক্ষে রয়েছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নদীকে লালন করা জরুরি। নদী আমাদের ইতিহাসের অংশ। উন্নয়ন মানেই পরিবেশ ধ্বংস নয়। পরিবেশ ও অর্থনীতি দুটো মেনে নিয়ে নদী রক্ষা করা সম্ভব। এজন্য শুধু প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। তিনি বলেন, দখলদাররা যা প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি দখল করে নিচ্ছে। নদী রক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা করলে টেকসই হবে।
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, আমরা শিল্পায়ন করছি, রফতানি বাড়াচ্ছি, উন্নয়ন করছি। বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি। তবে নদী না বাঁচলে এই উন্নয়ন কাজে আসবে না। তিনি বলেন, নদী দখলদার উচ্ছেদে কার্যকরি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নদী রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলেই জীবন রক্ষা পাবে।
নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে উচ্ছেদ কার্যক্রমে সরকারি সংস্থাগুলোর কাঙ্খিত সহযোগিতা না করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ২০১৯ সালে উচ্ছেদ অভিযানে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দফতর, বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রত্যাশিত বা আশানুরুপ ছিল না। তবে আগের তুলনায় অগ্রগতি হয়েছে। উচ্ছেদ কার্যক্রমে অপ্রতুল অর্থায়ন করা হয়েছে। উচ্ছেদের ক্ষেত্রে অর্থায়নে চরম গুরুত্বহীনতা ও অবহেলা লক্ষনীয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতে নদীর অবৈধ দখলদারের সংখ্যা আট হাজার ৮৯০ জন। এর মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে এক হাজার ৪৫২জন। এসব জেলায় দখলদারের ৫০ শতাংশ উচ্ছেদ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে নদী দখলদার ৪ হাজার ৭০৪জন। এর মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ২৩০ জন। খুলনা বিভাগে ১১ হাজার ২৪৫জন নদী দখলদার রয়েছেন। এর মধ্যে চার হাজার ৮৯০ জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বরিশাল বিভাগের পাঁচ হাজার ৬১১ জন দখলদারের মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৭৯৩ জনকে। সিলেট বিভাগের দুই হাজার ৪৪জন নদী দখলদার রয়েছেন। তাদের মধ্যে উচ্ছেদ হয়েছে ৫৭৬জন। ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে চার হাজার ৮৪৮জন নদী দখলদারের মধ্যে এক হাজার ৭০৭জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। রংপুর বিভাগের নদীগুলোতে দুই হাজার ৭৬০জন দখলদার রয়েছে। এর মধ্যে ৮১৩জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। রাজশাহী বিভাগের দুই হাজার ৬৯৩জন দখলদারের উচ্ছেদ করা হয়েছে ৪১ জনকে।
মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে নদী রক্ষা কমিশনের সার্বক্ষনিক সদস্য মোঃ আলাউদ্দিন, অবনৈতিক সদস্য শারমীন সোনিয়া মুরশিদ, আইনজীবী মনজিল মোর্শেদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।