বিএনপি নিধনের জন্যই দুদককে সাজিয়েছেন শেখ হাসিনা: রিজভী
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এবং সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন ‘দুজনই লুটেরা, দুজনই দুর্নীতিবাজ’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী।
তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে ঢাকা সিটি দক্ষিণের মেয়রের পদ দখল করেছিলেন সাঈদ খোকন। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নিশিরাতের এমপি পদ ছেড়ে কোনও মধুর লোভে মধুমতি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলে নূর তাপস মেয়র পদ দখল করেছেন। সেই মধুভাণ্ডের কাহিনী এখন আরব্যরজনীর গল্পের মতো মনে হলেও সেটিই বাস্তবে ঘটেছে। সাঈদ খোকন বলছেন, ‘মেয়র তাপস শত শত কোটি টাকা লুট করছেন’, অপরদিকে মেয়র তাপস বলছেন, ‘শত শত কোটি টাকা লুট করেছেন সাঈদ খোকন’। দু’জনই রাজপথে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে একে অপরের দুর্নীতি, লুটপাটের ফিরিস্তি দিচ্ছেন। তবে এটি স্পষ্ট যে, তারা দুজনই লুটেরা, দুজনই দুর্নীতিবাজ। এখন দুদক কী করবেন? তামাশা দেখবেন, না পদক্ষেপ নেবেন? দুদক পদক্ষেপ নিতে পারবে না, কারণ দু’জনই ক্ষমতাশালী ও শীর্ষ নেতৃত্বের আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজন।’
গতকাল মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘শেখ হাসিনার দুদক এদের (তাপস-খোকন) বিরুদ্ধে এক পা-ও অগ্রসর হতে পারবে না। কারণ বিএনপি নিধনের জন্যই দুদককে সাজিয়েছেন শেখ হাসিনা। জনগণকে ভোটাধিকার বঞ্চিত করে, জনগণের বিরুদ্ধে ইউনিফর্ম পরা সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে আর বেশিদিন মানুষের মুখ বন্ধ করে রাখা যাবে না। কথায় বলে ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’।’
তিনি বলেন, ‘ওবায়দুল কাদেরের আপন ছোট ভাই আব্দুল কাদের মির্জা যেসব অভিযোগ উত্থাপন করছেন এসব কথার উদ্দেশ্য যাই হোক, তার বক্তব্যে অনেক সত্য বেরিয়ে আসছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে খোদ ওবায়দুল কাদের সাহেব জিতবেন কিনা, তার আপন ছোট ভাই-ই এ প্রশ্ন তুলেছেন। আওয়ামী লীগের এই তিনজন (তাপস-খোকন-কাদের মির্জা) নেতার সাম্প্রতিক বক্তব্যে আবারও প্রমাণিত হয়েছে- আওয়ামী লীগের ‘টপ টু বটম’ আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। লুটপাটে কে কাকে টক্কর দিতে পেরেছে এ নিয়েই তাদের মধ্যে ঝগড়া চলছে। আওয়ামী লীগ তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে গিয়ে যে সত্য তুলে ধরছে তাতে প্রমাণিত, আওয়ামী লীগ এখন ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এদেশে দুর্গতির জনকই আওয়ামী লীগ।’
বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, ‘গতকাল ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভিশপ্ত কালো দিবসের চৌদ্দ বছরপূর্তি। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি অসাংবিধানিক তথাকথিত এক সরকার ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, নাগরিক মর্যাদা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। গণতন্ত্র হত্যা, মানুষের অধিকার হরণ করে দেশকে নিক্ষেপ করেছিল একটা অন্ধকার গহ্বরে। দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তিকে নির্মূল করার জন্য দীর্ঘ দিনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন গং এর তথাকথিত অবৈধ সরকার। দু’বছর ধরে দেশকে ছিন্নভিন্ন করে এই গণতন্ত্রবিনাশী গোষ্ঠী মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসেবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে একটি পাতানো ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে তাদেরই বশংবদ আরেক গণতন্ত্র হত্যাকারী ও লুটেরা গোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে গেছে। গত এক যুগ ধরে এই আওয়ামী দস্যুরা কথিত ওয়ান-ইলেভেনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জনগণের মধ্যে বিচ্ছেদ, বিনাশ, ব্যবধান সৃষ্টি করে একদলীয় ফ্যাসিজমের ন্যায় দেশে জালিমের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। তথাকথিত ওয়ান ইলেভেনের পর পথ হারিয়েছে বাংলাদেশ, জনগণ হারিয়েছে গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার। মনে হয় আইনের শাসন নয়, দেশ চলছে এক প্রভুর এক আইনে।’
রিজভী বলেন, ‘গতকাল সোমবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি আয়োজিত “এক এগারো : বিরাজনীতিকরণের ধারাবাহিকতায় চলমান ফ্যাসিবাদ-গণতন্ত্রই মুক্তির পথ” শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান বলেছেন, আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, ৭৫ এর নভেম্বরের পরাজিত অপশক্তি ক্ষমতায় থাকলে দেশে গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার থাকবে না। ৭৫ এর নভেম্বরের পরাজিত অপশক্তি ক্ষমতায় থাকলে রাষ্ট্র ও সমাজে মহান মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, সাম্য-মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কথিত এই ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপটে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার-‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও’।’
রিজভী বলেন, ‘তারেক রহমান আরও বলেছেন, বর্তমানে যে রাজনৈতিক অপশক্তি গণতন্ত্র হত্যা এবং ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতা জবর দখল করে আছে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তাদের পূর্বসূরিরাও একইভাবে মানুষের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করেছিল। তারা দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হতে দেয়নি, তারা দেশে জন্ম দিয়েছিলো সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য। গণতন্ত্রকামী জনগণ তাদের এমন নৈরাজ্য মেনে নেয়নি। বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসর তথা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অপশক্তিকে পরাজিত করেছিল। দেশের সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে ৭৫ এর ৭ নভেম্বরের সেই পরাজিত অপশক্তি এখন মহাজোটের নামে একজোট হয়েছে। এখন ৭৫ এর ৭ নভেম্বরের পরাজিত অপশক্তির মিশন হচ্ছে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং দেশের শক্তিমত্তার প্রতীক সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে রাখা। দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক ‘মাদার অফ ডেমোক্র্যাসি’ বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির সাফল্য যাত্রা বাধাগ্রস্ত করতে অত্যন্ত সুপরিকল্পতিভাবে ৭৫ এর ৭ নভেম্বরের পরাজিত অপশক্তি ২০০৪ সালে ‘২১ আগস্টের’ ঘটনা ঘটায়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা’ এবং কথিত ‘ওয়ান ইলেভেন’ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। ‘২১ আগস্ট’ এবং কথিত ‘ওয়ান-ইলেভেন’ একই সূত্রে গাঁথা। একটি ‘ওয়ান-ইলেভেন’ এর নাটক মঞ্চস্থ করার জন্যই পরিকল্পতিভাবে ঘটানো হয়েছিলো ‘২১ আগস্টের ঘটনা’। ৭৫ এর নভেম্বরে যারা দেশকে উল্টো পথে নিতে ব্যর্থ হয়েছিল, ২০০৭ সালে কথিত ‘ওয়ান-ইলেভেনে’র মাধ্যমে তারা সফল হয়। এরপরই তারা দেশের জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে লিপ্ত হয়। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিডিআর পিলখানায় সুকৌশলে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ছিল তাদের সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নেরই অংশ।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব আরও বলেন, ‘আলোচনা সভায় জনাব তারেক রহমান বলেছেন, ৭ নভেম্বরের পরাজিত অপশক্তি ষড়যন্ত্রের পথ ধরেই কথিত ‘২১ আগস্ট’ আর ‘ওয়ান ইলেভেনের’ আড়ালে ২০০৭ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এখন তারা তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে। প্রতিশোধ নিচ্ছে জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে।’
রিজভী বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের সেনাবাহিনীর গৌরব ও মর্যাদার কথার স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, সরকারের বিভিন্ন প্রজেক্টের ডিরেক্টর হওয়া কিংবা জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশন-ই একটি দেশের সেনাবাহিনীর একমাত্র ‘ভিশন’ হতে পারে না। বরং, একটি দেশের সেনাবাহিনী একটি দেশের সাহস, গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক। দেশের যেকোনও ক্রান্তিলগ্নে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিজ দেশের জনগণের মনে যেমন সাহসের সঞ্চার করে তেমনই বহিঃশত্রুর বুকে কাঁপন ধরায়। তিনি বলেন, সীমান্তে ‘ফেলানী’দের হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে, নিজ দেশের মর্যাদার পক্ষে কথা বলায় ‘আবরার’দের পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, সেনাবাহিনীর অফিসার পরিচয় দেয়ার পরও সেনা কর্মকর্তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে, নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা পরিচয় দেয়ার পরও চড় থাপ্পড় কিল ঘুষি দিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলা হচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, যারা বলেছিলো, ওয়ান ইলেভেন তাদের আন্দোলনের ফসল, তাদের কাছে দেশের স্বার্থ বড় নয়, বরং পরিবারের স্বার্থ বড়। তাদের কাছে দেশের মর্যাদা বড় নয়, কথিত স্বামী-স্ত্রীর কূটনীতিই বড়। তারা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করছে। গণতন্ত্রকে ইতোমধ্যে ধ্বংস করে ফেলেছে। এক-এগারো সরকার তাদের প্রভুদের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে সম্পূর্ণ বিনাভোটে আবারও তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসা হয়। আমরা এটাও জানি, ২০১৮ সালে একই কায়দায় আগের রাতে জনগণের ভোট চুরি করে আবারও সেই অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তারা এখন জনগণের ঘাড়ে চেপে দেশকে লুটেপুটে ফোকলা করছে। খুন, গুম, হামলা, মামলা, নিপীড়ন ও সকল অধিকার হরণের মাধ্যমে মানুষের জীবনকে বিষময় করে তুলেছে। এই ফ্যাসিস্টদের পরাস্ত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এই আহবানে সাড়া দিয়ে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীসহ দল-মত নির্বিশেষে গণতন্ত্রমনা সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নামার উদাত্ত আহ্বান রিজভী।
বিএনপির এই শীর্ষনেতা আরও বলেন, ‘কথিত ওয়ান ইলেভেনের অনিয়মতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক সরকারের কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কারণে গত একযুগ ধরে জনগণের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের এমন একটা সরকার চেপে বসেছে যাদের নীতি গুম, খুন, অপহরণ, অবিচার, অনাচার, লুটপাট, টাকা পাচার আর দুর্নীতি। অবস্থা বর্তমানে এতোটাই বিপর্যস্ত যে, গণতন্ত্র এবং ভোটাধিকার হরণকারী নিশিরাতের এই সরকারের নেতা-মন্ত্রী-এমপি-মেয়ররা দুর্নীতির টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে এখন নিজেরাই একে অপরের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সরকারের মেগা মেগা মহাদুর্নীতির মহাসাগর থেকে ছিটেফোঁটা চিত্র দু-একজন নেতার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে।’