মানুষ মৃত্যু আতঙ্কে ভুগছে, দেশে এখন ‘খুন আর নুন’ সমমূল্যের: রিজভী
মানুষ মৃত্যু আতঙ্কে ভুগছে, এমন দাবি করে দেশে এখন ‘খুন আর নুন সমান মূল্যের’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী।
বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, ‘এই নিশিরাতের কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরকারের বর্তমান মেয়াদে যুগপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ‘নির্জলা মিথ্যাচার’ করেছেন। তাঁর এই বিভ্রান্তিকর ও দুরভিসন্ধিমূলক ভাষণ অন্তঃসারশূন্য কথামালার ফুলঝুরি ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রধানমন্ত্রী দেশের তথাকথিত উন্নয়ন, মানুষের জীবনমান বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, স্বাস্থ্যখাতের ইতিবাচক পরিবর্তন, আইনের শাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানসহ যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা ‘মিথ্যাচারের কালো দলিল’। দেশবাসী তাঁর এই ভাষণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।’
শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) সকালে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রিজভী বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র হত্যা, ভোটাধিকার হরণ, খুন, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, টাকা পাচার, দুর্নীতি-লুণ্ঠন ও দুর্বৃত্তায়ন, দুঃশাসনের একযুগ পার করলো বাংলাদেশ। বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে ক্ষমতাসীন দুষ্টচক্র মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য-মানবাধিকার-ন্যায়বিচারকে নির্বাসনে পাঠিয়ে জনগণকে বোকা বানাতে তথাকথিত উন্নয়নের স্লোগান তুলেছে। উন্নয়নের নামে ক্ষমতাসীন দুষ্টচক্রের গত একযুগের এই দুঃশাসনের সঙ্গে একমাত্র বিতাড়িত তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের কথিত উন্নয়নের এক দশকের তুলনা চলে। গণতন্ত্র হত্যা করে, মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সময়কালে তথাকথিত উন্নয়নের এক দশক যুগপূর্তি উদযাপন করেছিলেন আইয়ুব খান। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার হরণ করে আইয়ুব খানের কথিত উন্নয়ন জনগণ মেনে নেয়নি। জনগণকে বোকা বানানো যায়নি। বরং ‘৬৯ এর গণঅভ্যুথানে স্বৈরশাসক আইয়ুবের নির্মম পতন ঘটে।’
বিএনপির এই শীর্ষনেতা বলেন, ‘এখনও যারা গণতন্ত্র হরণ করে, মানুষের বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে কথিত উন্নয়নের একযুগ পূর্তি করতে চান, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সেদিন আর বেশি দূরে নয়, স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের মতো তাদেরও পতন হবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।’
‘করোনা টিকা নিয়েও আওয়ামী সরকারের মাস্টারপ্ল্যান জনগণের কাছে পানির মতো পরিষ্কার। গতকালও প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা বলেছেন- করোনা টিকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ভারতই নাকি টিকা রফতানি করবে। কিন্তু গতকালই ভারতীয় হাইকমিশনার বলেছেন- বাংলাদেশে কবে টিকা আসবে তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো? টিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের ‘স্বনির্মিত মিথ্যাচারই’ প্রমাণিত হয়েছে’- যোগ করেন তিনি।
রিজভী আরও বলেন, ‘এখন চলছে বাংলাদেশের মহান বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীর ক্ষণগণনা। লাখো প্রাণের বিনিময়ে, অসংখ্য অগণিত মা-বোনের সম্মান-সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দেশপ্রেমিক জনগণ আজ যেন নিজ দেশে পরাধীন। ‘গণতন্ত্রের মা’ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত নন। তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান মিথ্যাচার ও প্রতিহিংসার শিকার। গত একযুগ ধরে দেশে চলছে আওয়ামী জাহেলিয়াতের শাসন-শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতন-গুম-খুন-লুণ্ঠন।’
‘শুধু একজন মাত্র ব্যক্তির ক্ষমতার খায়েশ মেটাতে দেশের প্রতিটি সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। দেশটাকে পরিণত করা হয়েছে দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্যে’- প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন রিজভী।
তিনি বলেন, ‘গত এক দশকে দেশ থেকে ৯ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করে দেয়া হয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ড থেকে লোপাট করা হয়েছে ৮১০ কোটি টাকা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে জনগণের ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা লুটে নেয়া হয়েছে। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতিবাজরা কানাডায় গড়ে তুলেছে বেগমপাড়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে তুলেছে অবৈধ সম্পদের পাহাড়। জনগণ যাতে ক্ষমতাসীনদের অনিয়ম-অনাচার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে এজন্য একদিকে ভিন্ন দল ও মতের মানুষের পেছনে ইউনিফর্ম পরিয়ে দলীয় সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছে, অপরদিকে নন-ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে মানুষকে অযথা বিতর্কে ব্যস্ত করে রাখা হয়েছে। ক্ষমতার উন্মাদনার মধ্যেই থাকতে চায় এই সরকার। প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণই দেন না কেন, কেবলমাত্র স্বৈরাচার হিসেবেই তাঁর বিশ্বজোড়া নামডাক হয়েছে।’
বিএনপির এই সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট, নাৎসিদের থেকে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান এই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনাসহ প্রতিটি গণতন্ত্রবিরোধী কর্তৃত্ববাদী সরকারের কাছে জনগণকে বোকা বানিয়ে শোষণের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে ঝুড়ি ঝুড়ি উন্নয়ন ও জিডিপি’র উদ্ভট গল্প। বিশ্বের দেশে দেশে স্বৈরাচারী শাসকদের মতো বাংলাদেশেও গণতন্ত্র হত্যা করে চালু করা হয়েছে তথাকথিত উন্নয়নের আষাঢ়ে কাহিনী। সম্প্রতি বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের শহরগুলোতে বসবাসকারী ২১ শতাংশ পরিবার তাদের খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। এসব পরিবারের অনেকে রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যান। অনেকে একবেলা না খেয়ে থাকেন। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, দেশের ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শতকরা ৪২ ভাগ শিশু স্কুলে যাচ্ছে না। অর্থাৎ প্রকৃত উন্নয়ন নয়, এই সরকার এদেশের জনগণকে তেলাপোকার মতো অন্ধকারের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করছে।’
রিজভী বলেন, ‘আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আমার দেশের মানুষকে যদি না খেয়ে রাত কাটাতে হয়, স্বল্প আয়ের মানুষেরা যদি খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করতে না পারে, শিশুরা যদি স্কুলে যেতে না পারে তাহলে কীসের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, আর কিসেরইবা উন্নয়নের গল্প? মাত্র কয়েক দিনে মোটা চালের কেজি ৫/৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে, মুসুরের ডাল কেজিপ্রতি বেড়েছে ২০ টাকা, অথচ এই ডাল নিম্নআয়ের মানুষরা বেশি কেনে। পেঁয়াজের মৌসুমেও পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকার নিচে নামছে না, খোলা সয়াবিন ও পাম ওয়েল কেজিপ্রতি ১৫/২০ টাকা বেড়েছে। সুতরাং সাধারণ মানুষকে পেটে পাথর বাঁধতে হচ্ছে, আর প্রধানমন্ত্রী নিরাপদ জোনে থেকে উন্নয়নের গল্প শোনাচ্ছেন, কারণ তিনি জনগণের মুখোমুখি হতে চান না।’
তিনি বলেন, ‘যে উন্নয়ন সমাজে ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে না সেটি উন্নয়ন নয়। যে দেশে বিরোধী মত ও কণ্ঠ জালিমশাহীর হিংস্র আঁচড়ে ক্রমাগত জর্জরিত, সে দেশের ভোটারবিহীন প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের গল্প ঠাকুরমা’র ঝুলির গল্পকেও হার মানায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়েছিল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য। এমন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র যে রাষ্ট্রে থাকবে সাম্য-মানবিক মর্যাদা-ন্যায়বিচার। মানুষ শুধু খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে থাকার জন্যই জন্মায় না। তাহলে মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য কোথায়? মানুষ চায় স্বাধীনতা। চায় মানবিক মর্যাদা। চায় কথা বলার অধিকার। কিন্তু নিশিরাতের সরকার কথিত উন্নয়নের জিকির তুলে মানুষের স্বাধীনতা, মানবিক মর্যাদা কেড়ে নিয়েছে। শাসকের হাত রক্তমাখা। নানা মুখোশ শোভিত এই সরকার ক্রুরতা, চাতুরি, কুটিলতা, নিষ্ঠুরতায় পুঞ্জিভূত হয়ে আছে। কিন্তু মানুষকে পরাজিত করে মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে বিশ্বে কোনও দেশে কখনও কোনও স্বৈরাচার টিকে থাকতে পারেনি, বাংলাদেশেও পারবে না। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেও গণতন্ত্রকামী মানুষের ওপর একদলীয় কুখ্যাত বাকশাল ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, মানুষ তা গ্রহণ করেনি।’
আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কড়া সমালোচনা করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের এক যুগ পূর্তি নিয়ে মাতামাতি করছে সরকার আর তাদের অনুগত ব্যক্তিরা। স্বৈরশাসনে নিষ্ঠুর দমনে দৃশ্যতঃ স্থিতিশীল পরিবেশ থাকলে সুমধুর উন্নয়নের গালগল্প ও দুর্নীতি-লোপাট চলে সমানতালে। গত এক যুগে দেশে উন্নয়নের চেয়ে লুটপাট হয়েছে বহুগুণ। মেগা প্রকল্পের কয়েকটি কুমির ছানা যুগব্যাপী দেখিয়ে আর ক্ষমতার নিয়ামক শক্তিগুলোকে অবাধ সুযোগ সুবিধায় তুষ্ট করে তিনটি ভূয়া জাতীয় নির্বাচন পার করার মধ্যে তারা তাদের সাফল্য খুঁজছে। তাদের
এক যুগের সফলতা হলো-দেশের মানুষ এখন মৃত্যু আতঙ্কে ভুগছে এবং জীবিকার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে।’
রিজভী বলেন, ‘২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘ভিশন-২০২১’ বাস্তবায়নের বছর চলছে। তারা বলেছিল, ২০২১ সালে দেশের ৮৫% মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। ঘরে ঘরে চাকরি দিবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা। বিএনপি সরকারের আমলের চেয়ে বর্তমানে বেকারত্ব বেড়েছে অনেক! কেবল গত ৭ বছরেই বেকারত্ব বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ! দেশের ৬৬% তরুণ এখনও কর্মহীন। চাকরির বদলে তারা ঘরে ঘরে মামলা, গুম আর লাশ দিয়েছে। তারা বলেছিল ১০ টাকা সের চাল খাওয়াবে। বিএনপি আমলের ১২/১৩ টাকার মোটা চালের কেজি এখন ৫০ টাকা। ১৭ টাকার পেঁয়াজ ৩০০ টাকায় তুলেছিল আওয়ামী সিন্ডিকেট, ৬/৮ টাকার আলু ৫৫ টাকায়, ৬০-৭০ টাকার আদা-রসুন ২০০টাকায় খাওয়ানো কিংবা ২৫০ টাকার আবাসিক গ্যাস ৯৫০ টাকায়, ১৪ টাকার পরিবহন সিএনজি ৪৩ টাকায়, ১ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে ২ টাকা ৫০ পয়সার প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ এখন ৭ টাকায় তুলে পকেট কাটছে মানুষের। আর এখন খুন আর নুন সমান মুল্যের। ৫/১০ টাকার বাসভাড়া ৩০-৪০ টাকা, মোবাইল রিচার্জে শতকরা ৩৩ টাকা কেটে নেয়া, ধর্ষণকে মহামারি রূপ দেয়া, দেশের বন্দর, নদী, সড়ক-রেলপথ প্রায় বিনা মাশুলে প্রতিবেশী দেশকে ব্যবহার করতে দেয়া, দিনের ভোট আগের রাতে করে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে বনবাসে পাঠনো, সব টেলিভিশনকে বিটিভি বানানো, সংবাদপত্রকে নিজেদের প্রচারপত্রে রূপায়ণ, প্রশাসনের প্রতিটি স্তরকে আওয়ামী দলীয় শাখা কার্যালয়ে বিবর্তন, বাহিনীগুলোকে ব্যক্তি ও দলের ক্যাডার গ্রুপে পরিণত করেছে এক যুগে। এরপরও কোন মুখে তারা সাফল্য দাবি করে। বরং আওয়ামী লীগের এক যুগ পুর্তিতে উচিত ছিল ভোটাধিকার হরণ, গণতন্ত্র-মানবাধিকার হত্যা, গুম, খুন, জুলুম, নির্যাতন, দুঃশাসন, লুটপাট-দুর্নীতির জন্য জনগণের কাছে কড়জোরে ক্ষমা চাওয়া। ক্ষমা চেয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া।’