আমি শিক্ষক, আমাকে ক্লাসে যেতে দিন
বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সেই সহকারী অধ্যাপক ড. রুশদ ফরিদী ক্লাসে ফিরতে এবার আন্দোলনে নেমেছেন। ক্লাসে না ফেরা পর্যন্ত তিনি এই কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
গতকাল বুধবার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি ছবি পোস্ট করে লেখেন, ‘আজকের দিনের কর্মসূচি শুরু। ক্লাসে ফেরা না পর্যন্ত প্রতিদিন চলবে।’
জানা গেছে, সহকর্মীদের সঙ্গে ‘দুর্ব্যবহার ও অশিক্ষকসুলভ আচারণের’ অভিযোগে ২০১৭ সালে রুশাদ ফরিদীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। এর আগেও তার বিরুদ্ধে ছাত্রীর সঙ্গে ‘অনৈতিক কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগে একই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।
এ ঘটনায় হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন রুশাদ ফরিদী। গত ২৫ আগস্ট আদালত বাধ্যতামূলকভাবে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তাকে বিভাগে যোগদানে বিবাদীদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়।
হাইকোর্টের এমন নিদের্শনার পর প্রায় তিন মাস পর গতকাল মঙ্গলবার রাতে ক্লাসে ফেরার আকুতি জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন রুশাদ ফরিদী।
তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেয়া হলো-
‘আজকের দিনের ঘটনা নিয়ে কতটুকু জল ঘোলা হবে জানি না, একটু বিস্তারিত বলি।
ছবির প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান মহোদয়ের কক্ষের সামনে। এক ফাঁকে অন্যদিকে গিয়েছিলাম। তারপর এসে শুনলাম তিনি এসেছেন শুনে দেখা করতে গেলাম। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন ছিল যে তিনি আমার গতকালকের রেখে দেয়া চিঠি পেয়েছেন কিনা।
দরজা ফাঁক করে উঁকি দিলাম। উনি বললেন কী বিষয়? আমি একটু ভেতরে ঢুকতে আমার প্ল্যাকার্ডে উনার চোখ পড়ল। উনি আমাকে ডাকলেন ভেতরে আসতে। আসতেই বললেন তুমি কেন বারবার আমার কাছে আসছো? এই প্ল্যাকার্ড নিয়ে তুমি কেন ভিসির অফিসে যাচ্ছো না? আমি কী করতে পারি?
আমি বললাম স্যার আপনাদের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করেই তো উনারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই আপনারাই পারেন এর সুষ্ঠু সমাধান করতে। তাছাড়া বিভাগীয় প্রধান হিসেবে এই বিষয়টি নিয়ে সুষ্ঠু সমাধানের চেষ্টা করাটা আপনার দায়িত্বের ওপরেও পড়ে।
এই ধরনের কথোপকথনের এক পর্যায়ে উনি হঠাৎ প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেন। লাফ দিয়ে উঠে যেয়ে বললে তুমি আমার সঙ্গে আসো। আমি পেছনে পেছনে গেলাম। উনি বিভাগের দু’একজন কর্মচারীকে বললেন বাকি শিক্ষক যারা যারা আছেন সবাইকে খবর দিতে।
তো খবর পেয়ে একজন দুজন করে আসলেন। প্ল্যাকার্ড হাতে আমাকে চিড়িয়াখানা থাকা কারো দিকে তাকিয়ে থাকার মতোন করে তাকিয়ে কেউ কেউ চলে গেলেন।
তবে একজন শিক্ষক পুরোটা সময় থাকলেন। তিনি সেই ২০১১ সাল থেকে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সত্য মিথ্যার প্রলেপ মিশিয়ে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন শিক্ষক শিক্ষিকাকে উত্তেজিত করেছেন। আমাকে দুই দুইবার বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর পেছনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
আট-নয় বছরেও দেখলাম এই বিষয়ে উনার উৎসাহের বিন্দুমাত্র কমতি নেই। আমি উনার এই বিষয়টিতে এই রকম অধ্যবসায় দেখে বিমোহিত হলাম। হয়তো তিনি এইবারেও সফলকাম হবেন।
যাই হোক, কিছুক্ষণ পর একজন সহকারী প্রক্টর আসলেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান স্যার বিভাগের কর্মচারীদের সামনে আমাকে প্রচুর বকাঝকা করলেন। এরপর সহকারী প্রক্টর , চেয়ারম্যান স্যার আর ওই প্রচণ্ড উৎসাহী শিক্ষক মিলে অনেকক্ষণ চেয়ারম্যানের কক্ষে আলাপ আলোচনা করলেন। তারপর উনারা বেড়িয়ে গেলেন। আমিও আরো কিছুক্ষণ প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসলাম।
তো এর মধ্যে কিছু কিছু ছাত্র ছাত্রী এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। আমি খুবই অবাক হলাম। কারণ আমি আমার বাধ্যতামূলক ছুটির বেশির ভাগ সময়ই দেখেছি ছাত্র-ছাত্রীরা আমার সঙ্গে কথা বলতে খুবই অস্বস্তিবোধ করে।
খোঁজ নিয়ে জেনেছি বিভাগে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে আমার সঙ্গে সোশাল মিডিয়া বা অন্য কোনোভাবে যোগাযোগ থাকলে ইট হ্যাজ কনসিকোয়েন্স। কি ধরনের সেটা নিশ্চয়ই খোলাসা করে বলে দিতে হবে না।
তো ওরা এসে আমার সঙ্গে কিছু কথা বললো। আমি বললাম, তোমাদের দেখি অনেক সাহস! কারো কারো চোখে মুখে বিষাদ বেদনার ছাপ খুবই স্পষ্ট।
একজন বলল স্যার, আমরা তো প্রতিবাদ করা ভুলেই গেছি। তাই আপনাকে দেখে খুবই অবাক লাগে। আরেকজন তো আমার পাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তার চোখ ছল ছল। বলল, ভাবছি আমি আপনার পাশেই থাকি সারাক্ষণ।
আমি বললাম, দেখ এই নিয়ে তোমরা ঝামেলায় পড় সেটা আমি কোনোমতেই চাই না। এইটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত যুদ্ধ। এটা আমি একাই লড়ে এসেছি।
হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কাউকেই পাশে পাই নাই। এটা একা লড়তে লড়তেই আমি অভস্ত। এর জন্য আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের বিপদে ফেলতে চাই না।
বিদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। তারপর এসে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। সেখানে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কেন?
আমাকে এইরকম একটাই প্রশ্ন আজকে আমি যখন প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, একজন ছাত্রী প্রশ্ন করেছিল? স্যার আপনি কেন এইখানে আছেন? কেন আপনি এরকমভাবে সাফার করছেন?
আমি উত্তর দিলাম, আমি এইখানে আছি, সাফার করছি, যুদ্ধ করছি, সংগ্রাম করছি, তোমাদের জন্যই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে। তাদের শেখাতে, তাদের জীবনে সামান্য কিছু হলেও জ্ঞান, দক্ষতা এনে দিতে যেটা তাদের পরবর্তী জীবনের সহায়তা করতে।
আমার কারণে যদি একটিও ছাত্র বা ছাত্রীর জীবনে পজিটিভ কোনো পরিবর্তন আসে, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে? আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশে এইটাই আমার জন্য সবচেয়ে মহত্তম কাজ। এর চেয়ে বেশি সন্তুষ্টির কাজ আমার জন্য এই দেশে আর নেই। তাই আমি এখানে মাটি কামড়ে পড়ে আছি। থাকব।