বাংলাদেশে মানবাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
মহান বিজয়ের মাসে গত ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালন করেছে। একসাগর রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বিজয়ের ৪৯ বছর অতিক্রম করে ১৬ ডিসেম্বর ৫০তম দিবস আমরা পালন করেছি। কিন্তু বিজয়ের যে অর্জন তার কতটুকু এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছে সে পর্যালোচনা ও করণীয় মূল্যায়ন প্রয়োজন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা- গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার, মানবসত্তা ও মর্যাদার পরিস্থিতির বর্তমান বাংলাদেশে ভয়ানক অবনতি ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে আমাদের সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ শিরোনামে যে অঙ্গীকার করা হয়েছে তা মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা বাংলাদেশে অকার্যকর হয়ে গেছে। ৪৯ বছরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অর্জন হলো সমাজে ধনী ও দরিদ্রের বিশাল বৈষম্য এবং ফারাক সৃষ্টি। দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা সংবিধানের অঙ্গীকার ছিল তা আজ চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত। রাজনৈতিক ও সামাজিক খাতে অসহনীয় বৈষম্য দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। দেশে গণতন্ত্র নেই, রাজনীতি নেই, ন্যায্য কথা বলার ও মত প্রকাশের অধিকার নেই। একটি স্বাধীন দেশে পুলিশের অনুমতি নিয়ে সভা, সমাবেশ ও নির্বাচনী প্রচারণা করতে হয়! এমনই প্রেক্ষাপটে দেশে ৫০তম বিজয় দিবস ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন করা হয়েছে।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে (Resolution-217) ৩০টি অনুচ্ছেদ (Article)-সংবলিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা করা হয়। ঘোষণাপত্রের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- সব মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে সমান। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে সব মানুষের সমানাধিকার ও স্বাধীনতা লাভের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ঘোষণায় প্রত্যেক মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা (অনু-৩); বিনা কারণে কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন, নিপীড়ন, অমানবিক, নিষ্ঠুর ও অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি দেওয়া যাবে না (অনু-৫) এবং সব মানুষ আইনের চোখে সমান বিবেচনা করা হয়েছে। ঘোষণার অনুচ্ছেদ ১২তে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী নাগরিকের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন এবং যোগাযোগে ক্ষেত্রে কোনো প্রকার অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করতে পারবে না বলে অঙ্গীকার করা হয়েছে। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বাক-ব্যক্তির ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-১৯) এবং সংগঠন ও সমাবেশ করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘোষণায় সব মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অধিকারসহ অন্য অনেক মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মানুষের সব ধরনের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মানুষের আশা-ভরসার সর্বশেষ স্থান বিচার বিভাগকেও নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ করে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। একই আইনে সরকারদলীয় সদস্যদের বিচার হয় একরকম আর বিরোধী মতবাদের মানুষের জন্য অন্যরকম। বিচার বিভাগে এ ধরনের পক্ষপাতিত্ব ও বৈষম্য অতীতে কখনো দেখা যায়নি। বৈষম্যের বড় শিকার তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রের জন্য আপসহীন নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। জিয়া অরফানেজ মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও এবং অরফানেজ ফান্ডের কোনো অর্থ ব্যয় না হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে একটি মামলায় নিম্ন আদালত খালাস দেওয়ার পর সরকার উচ্চ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। শুধু তাই নয়, সরকার বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা করেছে। একইভাবে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে তার অনুপস্থিতিতে সরকার ৩১টি মামলা করেছে। সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়া যখন গৃহবন্দী এবং তারেক রহমান যখন ৬ হাজার মাইল দূরে নির্বাসনে, তখন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আদালত অবশ্য ইতিমধ্যে মামলা খারিজ করে দিয়েছে। বিরোধী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত এমন কোনো নেতা-কর্মী নেই যারা একাধিক মামলার আসামি নন। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৯৪ হাজার ৪১৬টি মামলায় ২৮ লাখ ১৫ হাজার ৫২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। সর্বশেষ এক হিসাবে দেখা যায়, মামলার সংখ্যা বর্তমানে ১ লাখের বেশি। শুধু বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার চিত্র থেকেই বোঝা যায় বর্তমানে দেশে কী পরিমাণ মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্য একটি দৃষ্টান্ত হলো বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। ৩০ ডিসেম্বর দিনে যে ভোট হওয়ার কথা ছিল তা ডাকাতি হয়ে যায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে আদৌ কোনো নির্বাচন হয়নি তা জাতিসংঘ, দ্য হিউম্যান রাইট ওয়াচ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনসহ অন্য ১৪টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিবৃতির মাধ্যমে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। এর পর থেকে যত নির্বাচন ও উপনির্বাচন হচ্ছে সেসব ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানে দেওয়া হয়েছে যা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা, তাও লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ অবস্থায় দেশে গণতন্ত্র না থাকলে, জনগণের সরকার না থাকলে মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষা করা সম্ভব নয়।
২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কী পরিমাণ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে, তা পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র ফুটে ওঠে। দেশের দুটি বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং ‘অধিকার’ দেশে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, জেল-হাজতে মৃত্যু, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যা বিভিন্ন সময় প্রকাশ করেছে। ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘অধিকার’ প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক দেশে ৫৭০ আর ‘আসকের’ তথ্যানুযায়ী ৬০১ জন গুমের শিকার হয়েছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ে নিহত হয়েছে ‘অধিকার’-এর তথ্যানুযায়ী ২ হাজার ৫২৭ আর ‘আসকের’ হিসাব মোতাবেক ৩ হাজার ৭১ জন। বর্ণিত সময়ে জেল হাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ‘অধিকার’-এর হিসাবমতে ৬৯৩ আর ‘আসকের’ তথ্য মোতাবেক ৭৯৫ জন। একই সময়ে ‘আসকের’ তথ্যমতে ধর্ষণের মতো অমানবিক ও জঘন্য ঘটনা ঘটেছে ১০ হাজারের বেশি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রকাশিত হিসাবে করোনাকালে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর (নয় মাসে) সময়ে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ৯৭৫ আর সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ২০৮টি। ধর্ষণের পর হত্যা ৪৩টি এবং ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন। এ ছাড়া দেশে ইভ টিজিং, যৌতুক, অ্যাসিড সন্ত্রাসসহ নারী ও শিশুর ওপর নানা ধরনের নির্যাতন নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি পুলিশ কর্তৃপক্ষ রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র সমাবেশ, মিছিল ও অবস্থান ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেছেন। পুলিশ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এ ধরনের কর্মকান্ড চালানো যাবে না বলে এক প্রজ্ঞাপন আগে থেকেই জারি রয়েছে। কিন্তু উল্লিখিত নির্দেশ বা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ বা বাস্তবায়নে দ্বৈতনীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রেস ক্লাবের সামনে জনগণের অগোচরেই এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। আট বছর আগে একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকান্ড থেকে বেঁচে থাকাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘ আট বছরে তারা কোনো ক্ষতিপূরণ ও বিচার পাননি। ক্ষতিগ্রস্তরা ৮০ দিন যাবৎ তাদের দাবি ও অধিকার আদায়ের জন্য প্রেস ক্লাবের ফুটপাথে অবস্থান ধর্মঘট করেছিলেন। পুলিশের নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের লক্ষ্যে অবস্থান ধর্মঘটরত ভাগ্যবিড়ম্বিত নারী ও শিশুদের রাতে ঘুমের মধ্যে লাঠিচার্জ করে তুলে দেওয়া হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সে সময় ঢাকা শহরে আরও অনেক সভা-সমাবেশ হয়েছে, যেগুলোয় পুলিশ কোনো বাধা দেয়নি, বরং তাদের নিরাপত্তা দিয়েছে। পুলিশের অনুমতি বা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট তা বলাই বাহুল্য।
বাংলাদেশে মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বহুবার উদ্বেগ জানিয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, নাগরিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আনুষঙ্গিক চুক্তির ধারাসমূহ বাংলাদেশ গ্রহণ করলেও প্রায় সব ক্ষেত্রে লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত স্পষ্ট। এসব লঙ্ঘনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফরের অনুমতি পাননি। গুমের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্পর্কে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা তথ্য-উপাত্ত চাইলেও সরকার তার কোনো জবাব দেয়নি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণকে সরকার অব্যাহতভাবে এড়িয়ে চলছে। আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যার ফলে মার্কিন সিনেটররা বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তাদের আমেরিকায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করেছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বহুবার বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গত ৭ ডিসেম্বর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ শাস্তির বিধান রেখে একটি অ্যাক্ট অনুমোদন করেছেন। এর আগে আমেরিকা, কানাডা ও যুক্তরাজ্যে এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা হয়। আশা করা যায়, এসব আইন বা অ্যাক্টের সঠিক বাস্তবায়ন হলে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার একই সুতায় গাঁথা। যে দেশে গণতন্ত্র নেই সে দেশে আইনের শাসন নেই এবং মানবাধিকারের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা ও বিচারহীনতার কারণেই মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ সত্য উপলব্ধি করেই দেশের সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদটির নামকরণ হয়েছে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ আমাদের পবিত্র সংবিধানের প্রস্তাবনায়ও মানুষের এসব মৌলিক বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনার এক অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
বিজয়ের এ মাসে কেউ বুকে হাত রেখে বলতে পারবে না যে আমাদের সংবিধানের উল্লিখিত উপস্থাপনা ও ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক বিষয়গুলোর কোনো অস্তিত্ব বর্তমান বাংলাদেশে আছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ধারণ করে সংবিধানের উল্লিখিত মৌলিক বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা সংবিধানের প্রধান অঙ্গীকার গণতন্ত্র বর্তমানে দেশ থেকে নির্বাসিত। বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। সমাজের সব ক্ষেত্রে নীতি ও নৈতিকতার মৃত্যু ঘটেছে। দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, বাক-ব্যক্তির কণ্ঠ রোধ, লুটপাট, চাঁদাবাজি, মুদ্রা পাচার, ব্যাংকের ঋণ খেলাপ, ব্যাংক ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ এবং মানুষের ভোটের অধিকার হরণ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্যের পরিবর্তে বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। সমাজের সব ক্ষেত্রে পচন লেগেছে। বিজয়ের ৪৯ বছর পর এ দেশের জনগণ বর্ণিত সব অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন, বৈষম্যের অন্ধকার থেকে আলোর মুখ দেখতে চায়।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধানের অঙ্গীকার এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করা জনগণের একমাত্র প্রত্যাশা। একনায়কত্বের শাসন, রাষ্ট্রের অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক কর্মকান্ড থেকে আজ দেশের সব মানুষ মুক্তি চায়। বিশ্বের ইতিহাস এবং আমাদের দেশের অভিজ্ঞতায় এ কথা সঠিক, কোনো একনায়কত্ব বা স্বৈরতন্ত্র সহজে ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি। তবে ইতিহাসের সাক্ষ্য এই, কোনো স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কত্ব বেশিদিন টিকতে পারেনি। অবশেষে সত্য ও ন্যায় বিজয়ী হয়েছে। পাকিস্তান শাসনামলে স্বৈরাচার আইয়ুব খান এবং বাংলাদেশের স্বৈরাচার এরশাদ গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে ভেসে গেছেন। দেশের জনগণকে মুক্ত করতে হলে জনজাগরণের বিকল্প নেই। স্বৈরতন্ত্রের পতন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের (যে নামেই হোক) অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের ইস্পাতকঠিন ঐক্য অপরিহার্য। ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন বা জনজাগরণ যত দ্রুত সংঘটিত হবে, দেশ ও জাতির জন্য ততই মঙ্গল।
লেখক : সাবেক মন্ত্রী, সিনিয়র সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিএনপি; এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ভূ-তত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।