ফ্যাসিবাদের রূপ উন্মোচন

0

আজকাল বৈশ্বিক রাজনীতিতে দু’টি শব্দ খুব বেশি উচ্চারিত। একটি হলো গণতন্ত্র এবং অপরটি ফ্যাসিবাদ। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের এই উপমহাদেশেও জনগণের মুখে শব্দ দু’টি অহরহ শুনতে পাওয়া যায়। কিছুকাল আগে যেমন গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের আওয়াজ শোনা যেত, এখন একনায়কতন্ত্রের জায়গাটা মনে হচ্ছে ফ্যাসিবাদের দখলে চলে যাচ্ছে। তা হলে প্রশ্ন আসে একনায়কতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদ কি আলাদা কিছু? প্রকৃত বিচারে ফ্যাসিবাদ একনায়কতন্ত্রেরই একটি বিশেষ রূপ হিসেবে বিবেচিত, যা প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইতালিতে গণতন্ত্রের ব্যর্থতা ও বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে চরম কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। বেনিটো মুসোলিনি ১৯১৯ সালে ইতালির মিলান শহরে ‘Fascio di Combantimento’ নামের ফ্যাসিস্ট দল গড়ে তোলেন। এর আগে পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, জার্মানি প্রভৃতি দেশে ফ্যাসিবাদের পূর্বাভাস দেখা দিলেও পরিপূর্ণ অর্থে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে ইতালিতে।

ফ্যাসিবাদের মূল চেহারা হলো, ফ্যাসিস্টরা জনগণের কথা শুনতে চান না; জনগণকে তাদের কথা মানতে বাধ্য হবে এই নীতির ওপর বিশ্বাস করে রাষ্ট্রের সর্বময় শক্তি প্রয়োগের দিকটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তারা মনে করেন, ব্যক্তিজীবনের যাবতীয় দায়দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করবে। রাষ্ট্রের পক্ষে রাষ্ট্রের অধিনায়কই এই দায়িত্ব পালন করবেন। আর এই একনায়কই হবেন সব ক্ষমতার অধিকারী ও প্রয়োগকর্তা। তিনি নাগরিক জীবনের শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তাভাবনা, এক কথায় সমগ্র জীবনকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করবেন। ব্যক্তির নিজের কিছু বলার বা করার থাকবে না। ব্যক্তির স্বার্থ রাষ্ট্রের মধ্যেই নিহিত। রাষ্ট্রবিরোধী কোনো ব্যক্তিস্বার্থ থাকতে পারে না। যদিও তেমন কোনো স্বার্থের সৃষ্টি হয় রাষ্ট্র তার শক্তি প্রয়োগ করে ধ্বংস করে দেবে। ফ্যাসিবাদের চেহারা উন্মোচন করতে গিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা জর্জি দিমিত্রভ বলেছেন, ‘ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে জাতি দাম্ভিক এবং লগ্নি পুঁজির সবচেয়ে বড় সাম্র্রাজ্যবাদী প্রতিভূর প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব।’

ফ্যাসিস্টরা খুবই নিষ্ঠুর ও নিমর্মতার সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অনেক নিষ্ঠুর ও নির্মম শাসকের ইতিহাস আমাদের সামনে আছে। প্রাচীনকালে ফ্যাসিস্ট নামে না হলেও তাদের চরিত্র ও নিষ্ঠুরতা ছিল একই রকম বা বর্তমানের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মিসরীয় সভ্যতার ফারাওদের নিষ্ঠুরতা, নির্মমতার যে ইতিহাস, তাতে প্রতিবাদী নাগরিকদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের লোমহর্ষক চিত্র পাওয়া যায়। মেসোপটেমীয় সভ্যতায়ও একই নমুনা পাওয়া যায়। আধুনিককালের জার্মানির হিটলার, স্পেনের ফ্রাঙ্কো, চিলির পিনোচেট, উগান্ডার ইদি আমিন, কম্বোডিয়ার পলপট, বলকানের কসাই সার্বিয়ান নেতা মিলোসেভিচ, জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে এর দৃষ্টান্ত। জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করে রাষ্ট্রীয় একনায়কতন্ত্র বজায় রাখার জন্য এরা লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছেন। উত্তর কোরিয়া, চীনসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই স্বৈরতন্ত্রের যে প্রত্যক্ষ রূপ দেখা যায়, সেখানে জনগণের অধিকার সঙ্কুচিত করা, ভোটাধিকার রহিত করা, বাকস্বাধীনতা হরণ, যখন তখন জেলে পোরা, রাষ্ট্রীয় মদদে গুম, খুন, অপহরণ প্রভৃতি নিত্যঘটনা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. লরেন্স ডব্লিউ ব্রিট ২০০৩ সালে ফ্যাসিবাদ বিষয়ে ‘ফ্যাসিজম কেউ?’ (Anyone Fascism?) শিরোনামে এক প্রবন্ধে হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কো, সুহার্তো ও চিলির পিনোচেটের শাসনকালসহ ইতিহাসের মোট পাঁচ কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট শাসনকাল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের ১৪টি বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করেছেন, যা প্রায় সব স্বৈরশাসকের আচরণের মধ্যে অভিন্নভাবে পাওয়া যায়। শক্তিশালী জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকারের স্বীকৃতি দিতে অবজ্ঞা, একক মতবাদের শত্রুকে সমষ্টিগত শত্রু হিসেবে আখ্যা দেয়া, সেনাবাহিনীর প্রাধান্য, চরম পুরুষতান্ত্রিকতা, নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম, জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্নতা, ধর্ম ও সরকার একই সুতোয় গাঁথা, করপোরেট শক্তির সুরক্ষা, শ্রমিক সংগঠন দমন, চিন্তাবিদ ও শিল্পীদের অনাদর, অপরাধের দণ্ড নিয়ে ব্যস্ততা, চরম ক্রান্তীকরণ ও দুর্নীতি এবং প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচন এগুলোই হচ্ছে ফ্যাসিবাদী সরকারের লক্ষণ। ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ব্রিটের এই আলোচনা বিশ্বের অনেক দেশের শাসকগোষ্ঠী সম্পর্কেই খাটে।

ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে বিরোধী মতবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করে থাকে। হামলা, মামলা, নিপীড়ন, নির্যাতনের মাধ্যমে প্রতিবাদী কণ্ঠ দমিয়ে রেখে নিজেদের জনবিরোধী চরিত্র ঢেকে রাখার চেষ্টা করে। উন্নয়নের নামে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস উসকে দিয়ে এই জাতীয় সরকার সমাজে বিভক্তির সৃষ্টি করে। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার গোষ্ঠীগুলোকে দমাতে বিশেষ বাহিনী ব্যবহার করে থাকে। রাষ্ট্রীয় মদদে এরা জনগণের ওপর বেপরোয়া আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

গণতন্ত্রের নামে ফ্যাসিবাদের বর্তমান রূপ হচ্ছে উন্নয়ন মডেল। এই মডেল নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের কথা বলে অধিকতর উন্নয়নের ধোঁকা দেয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে- আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র। আবার তারা নির্বাচনের নামে জনগণের সাথে প্রতারণা করতে ন্যূনতম দ্বিধাবোধ করে না। ইতিহাসের অনেক ফ্যাসিস্ট শাসকই নির্বাচিত ছিলেন। কিন্তু পরে তারা নির্বাচনকে স্র্রেফ এক জালিয়াতির অনুষ্ঠানে পরিণত করেন। হয় এদের অধীনে নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই থাকে না নতুবা ব্যাপক কারচুপি হয়। কারচুপি, দুর্নীতি ও অপশাসনকে ধামাচাপা দিতে বাকস্বাধীনতা স্তব্ধ করতে নিত্যনতুন আইন প্রণয়ন করে। তারা যত্রতত্র ‘উন্নয়নবিরোধী’ শক্র দেখতে পায়। যেকোনো কিছুকেই মনে করে ষড়যন্ত্র। ধনিক শ্রেণীকে অবারিত লুটপাটের সুবিধা করে দেয়া হয়। অবাধ দুর্নীতির কারণে ঘন ঘন ব্যাংক, বীমা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান মূলধন হারিয়ে অনেকেই দেউলিয়া হয়ে যায়। ঋণখেলাপিরা মুক্তি পায়। নাগরিক সেবার চেয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে বড় বড় অবকাঠামো বানানোকে গুরুত্ব দেয়।

২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি বিবিসি বাংলা নিউজে প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ), নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, নাগরিক অধিকার, সরকারের সক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ‘বিশ্বে যে স্বৈরতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা সামান্য বেড়ে গেছে, সেটার চেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও এখন নাগরিক অধিকার ক্রমেই খর্ব করা হচ্ছে এবং আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে’।

‘গণতন্ত্র’ প্রত্যয়টি দিয়ে সরকারের যে রূপ বোঝায়, সেখানে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু নাগরিকের সব সিদ্ধান্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ এর মূল দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, সরাসরি ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে জনগণের নিজেদের শাসন করার অধিকার থাকতে হবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা করাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। স্বাধীন বিচার বিভাগ, স্বাধীন গণমাধ্যম, বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু গণতন্ত্রের মোড়কে যেসব রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা করছে সেখানে কোনো প্রতিষ্ঠানকেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হয় না। সরকার যেকোনো উপায়েই হোক এসব প্রতিষ্ঠানকে ভয়ের মধ্যে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার কাজে ব্যবহার করে। যারা অবাধ্য হয়, তাদের জন্য পরিস্থিতি সুখকর থাকে না।

বিশ্বের অনেক দেশেই প্রতিবাদী মানুষের ওপর দমন নিপীড়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে মিয়ানমারে সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণ উলঙ্গভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সে দেশের নাগরিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে পদে পদে। অথচ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনের পর দীর্ঘদিন গৃহবন্দী অং সান সু চিকে সবাই গণতন্ত্রের ত্রাণকর্তা মনে করেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর তার আচরণ গণতন্ত্রপ্রেমী বিশ্ববিবেককে ধোঁকা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আফ্রিকা, এশিয়ার অনেক দেশেই গণতন্ত্রের পোশাক পরা ফ্যাসিবাদের বাহু সম্প্রসারিত। শুধু রাজনীতিই নয়, অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সব জায়গাতেই ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ চর্চিত। এর থেকে মুক্তির পথ দিনে দিনে সঙ্কুচিত হচ্ছে। জনগণ যদি গণতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জীবিত হতে না পারে হয়তো গণতন্ত্রের কোনো পথই আর খোলা থাকবে না। সর্বত্রই গণতন্ত্রের পোশাক পরে ফ্যাসিবাদের চাষাবাদ হবে। 

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com