থমকে আছে বিএনপির পুনর্গঠন
৮১টি সাংগঠনিক জেলার ১৯টিতে আহ্বায়ক কমিটি । আংশিক কমিটিতেই মেয়াদ শেষ স্বেচ্ছাসেবক দলের একই পথে যুবদলও । হাইকমান্ড ক্ষুব্ধ কৃষক দল ওলামা দল তাঁতী দল ও মৎস্যজীবী দলের ওপর
থমকে আছে বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। দলটির সাংগঠনিক কর্মকান্ডে গতি আসছে না কোনোভাবেই। ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ১৯টিতে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির দায়িত্বশীল নেতাদের তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে বলা হয়। নির্ধারিত সময়ে অধিকাংশ জেলাই পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি। এ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ বিএনপির হাইকমান্ড। অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল আংশিক কমিটি দ্বারা বছরের পর বছর পার করছে। তাদেরও নির্ধারিত সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে কয়েক দফা সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কমিটি দিতে তারাও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। দাবি উঠেছে নতুনভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের।
এদিকে নির্ধারিত সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি বিএনপির আরও চার অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল ও ওলামা দল। এরই মধ্যে বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের দুই শীর্ষ পদে নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা বানানো হয়েছে। ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা নিয়মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও যাচ্ছেন। তবে তারা এখন সব গ্রুপের নেতাকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের নেতা তারেক রহমান অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিএনপিকে গোছানোর কাজ প্রায় শেষ করে নিয়ে এসেছেন। নতুন প্রাণ সৃষ্টি করেছেন বিএনপির মধ্যে। এই দুঃসময়ে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে তিনি দলকে পরিচালিত করছেন। তিনি সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন।’
জানা যায়, ১৯ আহ্বায়ক কমিটির জেলার মধ্যে রয়েছে- নীলফামারী, হবিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নওগাঁ, যশোর, বগুড়া, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, সৈয়দপুর, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী, নেত্রকোনো, পঞ্চগড়, ঝিনাইদহ, মাগুরা, চট্টগ্রাম দক্ষিণ, ফেনী ও সিলেট। আংশিক থেকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়া ১০ জেলা- জামালপুর, লালমনিরহাট, খাগড়াছড়ি, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, শেরপুর ও নারায়ণগঞ্জ।
বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দাবি, ছাত্রদলের মতো বিএনপির সব অঙ্গসংগঠনের কমিটিও যেন কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের সব কমিটিই যেন নির্বাচিত হয়। যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলেও কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটি চান তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। যুবদলের মাত্র বাকি দুই মাস। তার পরও নানা সমীকরণে এ দুই অঙ্গসংগঠনের আংশিক কমিটি এখন পূর্ণাঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির হাইকমান্ড।
এদিকে পুনর্গঠন নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট নেতাদের সতর্ক করা হয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় এখন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলকে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নেন। এ কাজে দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেন। এসব নেতা প্রথমে কিছুটা নিরপেক্ষ থেকে কাজ করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক টিমের বিরুদ্ধে অনৈতিক লেনদেন, স্বজনপ্রীতি, প্রভাব খাটিয়ে কিছু নেতাকে সুবিধা দেওয়া, বিশেষ কোনো নেতাকে চাপে রাখা, নিজের বলয় সৃষ্টি ইত্যাদি নানা অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া এসব অভিযোগের ভিত্তিতে একাধিক টিম গঠন করা হয়েছে। তারা মাঠে কাজ করছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো টিম তাদের প্রতিবেদন জমাও দিয়েছে।
জানা যায়, অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে বরিশালের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনকে প্রথমে সতর্ক করা হয়। একই সঙ্গে পিরোজপুর জেলা বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া থেকে তাকেসহ তার টিমকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুরো বরিশাল বিভাগে শিরিনকে দল পুনর্গঠনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সেখানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। একইভাবে ময়মনসিংহ বিভাগেও কমিটি গঠন নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা ও মহানগর কমিটি জমা দেওয়ার পরও তা গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে জানা গেছে। সেখানে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন ফজলুর রহমান খোকন ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল। এর আগে ছাত্রদলের রাজীব-আকরামের ‘ঢাউস’ কমিটি ছিল। দলের হাইকমান্ড এতে ক্ষুব্ধ হন। সেখানে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ছিল ৭৩৬ সদস্যের।
ছাত্রদলের বর্তমান নেতৃত্ব জানান, তারা দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ১৫১ বা সর্বোচ্চ ১৭১ সদস্যের কমিটি করার চেষ্টা করবেন। সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়েই কমিটি করতে চান। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই কমিটি হবে এমনটা আশা প্রকাশ করে ছাত্রদল সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নানা প্রতিকূল পরিবেশেও আমরা কমিটি গঠন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা নিয়মিত ক্যাম্পাসে যাচ্ছি। সবাইকে নিয়েই দ্রুততম সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করব।’ যুবদলসূত্রে জানা যায়, ২০ অক্টোবরের মধ্যে যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরপর কয়েক দফায় সময় নিয়েও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা যায়নি। কমিটি গঠনে অলিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়Ñ ৪০ ভাগ সাবেক ছাত্রনেতাকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ নিয়েই কমিটি গড়তে হিমশিম খাচ্ছে যুবদল। যুব ও ছাত্রনেতা মিলে দেড় হাজারের ওপর নেতা। এর মধ্যে কমিটিতে জায়গা পাবেন বর্তমান নেতাসহ মাত্র ২৭১ জন। এদিকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রস্তুত হলেও একটি পদের তদবিরের কারণে ঘোষণা করা সম্ভব হচ্ছে না যুবদলের পূর্ণাাঙ্গ কমিটি। রাজাকার কমান্ডার পলাতক ফাঁসির আসামি জাহিদ হোসেন খোকনের বড় ছেলে খায়রুজ্জামান লিংকনকে যুবদলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক করায় প্রচ চাপে যুবদলের সুপার ফাইভ নেতা। স্পর্শকাতর এ সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পাচ্ছেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। সংগত কারণেই হাইকমান্ডের মর্জির ওপর এর দায়িত্ব দিয়ে শিগগিরই কমিটি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুবদল। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও। যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দলের হাইকমান্ডের নতুন করে নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা শিগগিরই কমিটি করার চিন্তাভাবনা করছি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্ধারিত সংখ্যার মধ্যেই কমিটি সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আশা করছি।’ যুবদল সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, ‘যুবদলের ৮২টি সাংগঠনিক জেলার সব কটির কমিটি করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে কেন্দ্রের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। কমিটি হবে ২৭১ সদস্যের।’
স্বেচ্ছাসেবক দলসূত্রে জানা যায়, মেয়াদোত্তীর্ণ স্বেচ্ছাসেবক দলও তাকিয়ে আছে যুবদলের দিকে। যুবদলের কমিটি হওয়ার পরই তারা কমিটি দেবে। তাদেরও ৪০ ভাগ সাবেক ছাত্রনেতা রাখার অলিখিত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ সংগঠনটির ৮১টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। এর প্রায় ৫০টিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। বাকিগুলো আংশিক কমিটি। আংশিক কমিটিগুলোও দ্রুতই পূর্ণাঙ্গ করা হবে। স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘নানাবিধ কারণে যথাসময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। এখন আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে চাই। সেভাবে কাজও চলছে।’ এ ছাড়া তিন মাসের মধ্যে কাউন্সিল করে নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য চার সংগঠনকে নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা করতে পারেননি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। অঙ্গসংগঠনগুলো হলো কৃষক দল, তাঁতী দল, ওলামা দল ও মৎস্যজীবী দল। এ চারটি সংগঠনের কর্মকা পর্যবেক্ষণে এখন আবার ‘পর্যবেক্ষণ কমিটি’ করেছে বিএনপি। সেই পর্যবেক্ষণ কমিটির কোনো কোনো নেতাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার কাজ চলছে। কোথাও কোনো অভিযোগ থাকলে তা দেখতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে একাধিক টিম কাজ করছে। সবাইকে বুঝতে হবে, মামলা-হামলাসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। এ কারণে হয়তো কিছু কমিটির মেয়াদ ১০-১৫ দিন পার হয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা কাউন্সিলের মাধ্যমে ছাত্রদল, ড্যাবের কমিটি করেছি। যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল পূর্ণাঙ্গ করার কাজ চলছে।’