কেমন আছে সেই তাতাররা

0

রুশ বলয়ভুক্ত ক্রিমিয়ার ঐতিহ্যসমৃদ্ধ তাতার মুসলিম জনগোষ্ঠী ৩০০ বছরের বাধা-বিপত্তি ও গোলামির জিঞ্জির ছিঁড়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর সংগ্রামে এগিয়ে চলেছে। অব্যাহত নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও গণনির্বাসন চালিয়েও তাতারদের মুসলিম জাতিসত্তা মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। আবার তারা জেগে উঠছে ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিজস্ব বলয়ে। পূর্ব ইউরোপে কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে আবার দেখা দিয়েছে ইসলামী নবজাগরণ। নতুন নতুন মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে এবং আনুপাতিক হারে বেড়ে চলেছে নামাজিদের সংখ্যা। উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ও তাওহিদি চেতনায় জীবন গড়ার তাগিদ তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে তাতারদের মাঝে। হারিয়ে যাওয়া তাতার ভাষার পুনরুজ্জীবনের জন্য ক্রিমিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গড়ে উঠেছে স্কুল। ক্রিমিয়ান তাতার হচ্ছে কৃষ্ণ সাগরের উত্তর উপকূলে অবস্থিত একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র। বহু উত্থান পতনের নীরব সাক্ষী ক্রিমিয়া। এ বিস্তীর্ণ অঞ্চল শত বছর ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও শাসকদের দ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। ২৬ হাজার ২০০ কিলোমিটারের আয়তনবিশিষ্ট ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্রের জনসংখ্যা প্রায় ১৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৮৫ জন। ক্রিমিয়া হচ্ছে তাতারদের জন্মভূমি, যারা নৃতাত্ত্বিকভাবে সংখ্যালঘু। গোটা জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ তাতার।

ক্রিমিয়ান তাতারদের পূর্বপুরুষ তুর্কি। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে তারা ক্রিমিয়া উপদ্বীপে বসবাস করে আসছে। মূল তাতাররা পঞ্চম শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ায় গোবি মরুভূমির উত্তর-পশ্চিমে বসবাস করত। নবম শতাব্দীতে খিতানরা তাদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলে তারা দক্ষিণ অভিমুখে যাত্রা এবং চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল শাসন কায়েম করে। চেঙ্গিস খানের দৌহিত্র বাতু খানের পরিচালনায় তাতাররা পশ্চিম দিকে রাশিয়ার সমতল অভিমুখে রওনা হয়। যাত্রার সময় তারা তুর্কি উরাল বংশোদ্ভূত জনগণকেও সাথে নিয়ে যায়। বর্তমানে ভাগ্যবিড়ম্বিত বিপুলসংখ্যক তাতার রাশিয়া, ইউক্রেন, মলদোভা, লিথুয়ানিয়া, বেলারুশ, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, চীন, কাজাখস্তান, তুরস্ক ও উজবেকিস্তানে বসবাস করে আসছে। তাতার জনগোষ্ঠীর একটি অংশ, ফিনল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে হিজরত করে স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছে। গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাতারদের জনসংখ্যা এক কোটিরও বেশি। চেঙ্গিস খানের বংশধর বার্কাই খানের (১২৫৭-৬৭) আমলে তাতারদের সাথে ইসলামের পরিচয় ঘটে। উজবেগের (১৩১৩-৪০) ক্ষমতায় আরোহণের আগ পর্যন্ত তাদের মাঝে ইসলাম ব্যাপকতা লাভ করেনি। চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি তাতারদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। চতুর্দশ শতকে পরিভ্রমণকারী পর্যটকরা এতদঞ্চলে ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন। সময়ের বিবর্তনে ইসলামী অনুশাসন, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি তাতারদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

কিপচাক সাম্রাজ্যের (Golden Hordes) পতনের পর ওই অঞ্চলের উপর গড়ে ওঠা তাতার রাজ্যসমূহের মধ্যে ক্রিমিয়াই ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীন রাজশক্তি। ক্রিমিয়ার এই তাতার বংশের রাজত্বকাল ১৪২০ থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে ৩০০ বছর স্থায়ী হয় এবং সিমফেরোপোলকে রাজধানী করে পর্যায়ক্রমে ৬২ জন তাতার খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। কাজান বংশের প্রতিষ্ঠাতা উলুঘ মুহাম্মদের জনৈক ভ্রাতা তাশ-তিমুর তোখতামিশের সেনাপতি ছিলেন এবং তিনিই ক্রিমিয়ায় তাতার বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ‘গিরাই খান’ নামে পরিচিত তাতার শাসকদের সাথে পোল্যান্ডের ডিউক ও উসমানীয় তুর্কি সুলতানরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে ক্রিমিয়া অবস্থিত হওয়ায় এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব¡ সম্পর্কে সবাই ছিলেন সজাগ। বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তাতাররা দুই লাখ সদস্য বিশিষ্ট দুর্ধর্র্ষ সেনাবাহিনী গঠন করে যার মাধ্যমে পোল্যান্ড, রাশিয়া ও কসাকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালিত হয়। এমনকি ১৫৭০ সালে প্রথম দওলত গিরাইয়ের নেতৃত্বে তাতার বাহিনী রাশিয়ার প্রতাপশালী জার আইভানকে পরাজিত করে মস্কো নগরী বিধ্বস্ত করে দেয় এবং জারকে কর দিতে বাধ্য করে। সে সময় ককেসাস, দাগেস্তান ও রুমানিয়ার ওপরও তাতারদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

অবশেষে কৃষ্ণ সাগরের ওপর আধিপত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রাশিয়ার জারিনা ক্যাথারিন ১৭৩৬ ও ১৭৩৮ সালে ক্রিমিয়াকে বিধ্বস্ত করেন এবং ১৭৭১ সালে রুশ ও কসাক বাহিনী ক্রিমিয়ার রাজধানী সিমফেরোপোল দখল করে নেয়। কৃষ্ণ সাগরে রুশদের অবাধে প্রবেশের জন্য জার পিটারের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন ক্রিমিয়া দখলের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করল। ১৭৭৪ সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সম্পাদিত কুচকায়নারজির সন্ধিতে ক্রিমিয়া স্বাধীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে ছিল। ১৭৭৪ থেকে ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত তাতাররা নির্বিঘ্নে ক্রিমিয়া ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করে। নিজেদের সন্তানদের তারা উচ্চশিক্ষার জন্য বুখারার বিখ্যাত মাদরাসায় পাঠাতে থাকে। এমনকি তাতারদের পূর্বপুরুষরা যারা খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তারা ইসলাম ধর্মে ফিরে আসেন। কিন্তু তাতারদের এ স্বাধীনতা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

পরিশেষে ক্রিমিয়ার খান শাহীন গিরাইয়ের সাথে তুর্কি সুলতানের মনোমালিন্যের সুযোগে সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে ১৭৮৩ সালের ৯ এপ্রিল রুশ জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ওই ঘোষণায় তাতারদের ধর্মীয়, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার অক্ষুণ্ন থাকার আশ্বাস দেয়া হলেও তা আদৌ কার্যকর করা হয়নি। বস্তুত রুশদের অধীনে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর পরবর্তী ইতিহাস বড়ই মর্মন্তুদ ও হৃদয়স্পর্শী। জারদের অব্যাহত বর্বরতায় তাতাররা সীমাহীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়নের শিকার, এমনকি জোর করে তাতারদের ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়। নিজেদের সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ভিত্তি যখন বিধ্বস্ত হয়ে যায়, তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুই লাখ ৫০ হাজার তাতার মুসলিম নারী-পুরুষ স্বদেশ ভূমি পরিত্যাগ করে তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। শত নিগ্রহ ও নির্যাতন সত্ত্বেও যারা পৈতৃক বাস্তুভিটা পরিত্যাগ করেনি তাদের ওপর নেমে আসে পৈশাচিকতার খড়গ কৃপাণ। ১৮৫৪ সালে বহুলালোচিত ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে এতদঞ্চল সাময়িকভাবে তুরস্ক ও ইংরেজদের অধীনে চলে যায়। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতি তাতার মুসলমানদের জন্য সৃষ্টি করে নতুন বিপদ। রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অপরাধে ক্রিমিয়ার তাতারদের অভিযুক্ত করা হয়। জারের সন্ত্রাসীগোষ্ঠী জিঘাংসার উন্মত্ততায় নির্বিচারে ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও নিপীড়ন চালিয়ে তাতারদের নির্মূল প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে Ethning cleansing অভিযান। ইতিহাসবিদ জি, হ্যান্বলি Central Asia শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ১৭৮৩ সালে ক্রিমিয়ায় যেখানে তাতার মুসলমানদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ, নির্মূল অভিযানের ফলে ১৯১৭ সালে সে সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র এক লাখে।

নানামুখী অত্যাচার ও নিপীড়নে বিধ্বস্ত হয়েও ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানরা বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালায়। ইসমাইল বে নামক জাতীয়তাবাদী এক নেতার নেতৃত্বে তাতারদের মধ্যে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ের মাধ্যমে তিনি তাতারদের চধহ ওংষধসরপ আদর্শে সংগঠিত করেন এবং ১৯১৭ সালে ‘মিল্লি ফিরকা’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দেন। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘তরজুমান’ পত্রিকা যুবকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায়। গণহারে দেশত্যাগ এবং নানা জাতির সংমিশ্রণের ফলে তাতাররা ক্রিমিয়ায় ক্রমান্বয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
১৯২০ সালে কমিউনিস্ট বলশেভিকরা ক্রিমিয়াকে সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক ইউনিয়নের (USSR) অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ১৯২০-২৭ সাল পর্যন্ত মোট সাত বছর স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র হিসেবে ক্রিমিয়া পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ভোগ করে। এমনকি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ও মিল্লি ফিরকা কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। তাতার ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয় এবং মুসলমানরা সরকারি উচ্চপদে নিযুক্তি লাভ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এ সৌভাগ্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯২৮ সালে মস্কো সরকার তাতার জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নির্মূল করার জন্য কঠোরতম পন্থায় আঘাত হানে। এতে, তাতার মুসলমানদের স্বাধীনভাবে বাঁচার স্বপ্নসাধ সাময়িকভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পুরো তাতার জনগোষ্ঠীকে স্বৈরাচারী রুশ শাসক স্ট্যালিন নাজি জার্মানির দালাল হিসেবে অভিযুক্ত করে প্রতিশোধের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৪ সালে স্ট্যালিন সরকার ক্রিমিয়ান তাতারদের ভাষাকে সিরিলিক (Cyrillic) লিপিতে পরিবর্তিত করে দেয়। রুশ বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে ক্রিমীয়দের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে মুছে ফেলা হয়। পারিবারিক জীবনে, সামাজিক বন্ধনে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রচণ্ড ধস নামে। অতঃপর শুরু হয় তাতার মুসলমানদের পুনঃ উৎখাতের পালা। স্ট্যালিনের নির্দেশে তাতার মুসলমানদেরকে নিজ মাতৃভূমি ক্রিমিয়া থেকে জোর করে বের করে দেয়া হয়। বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ ও শিশু গণহত্যার শিকার হয়। বেশির ভাগ তাতার বাস্তুভিটা ও সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে সাইবেরিয়া ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিশেষত উজবেকিস্তানে উদ্বাস্তুরূপে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তাতাররা সোভিয়েত শাসনের প্রতি ‘অনুগত’ নয়- স্ট্যালিনের এ কথিত যুক্তিই ছিল নির্বাসনের ভিত্তি। তিনি তাতারদের ‘অবিশ্বস্ত নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ৫০ হাজার থেকে এক লাখ তাতারকে তিনি দেশ ত্যাগে বাধ্য করেন। বিপুলসংখ্যক তাতারের জীবন প্রদীপ নিভে যায় কারাগারের অন্তরালে। তখনকার আদমশুমারি অনুযায়ী, তাতার মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ২৩ শতাংশে।

ষষ্টাদশ ও বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে জার রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রিমিয়ার জনগণের প্রতি দমনমূলক শাসন ও পক্ষপাতদুষ্ট আর্থসামাজিক নীতি গ্রহণ করেও ব্যাপকভাবে এ অঞ্চলকে রুশীয়করণ করতে ব্যর্থ হয়। বেশির ভাগ জনগণ রুশ আত্মীকরণকে দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান এবং ইসলামী পরিচিতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইসলামী অনুশাসন প্রতিপালনের ব্যাপারে দৃঢ়তার ফলে তাতার জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সামাজিক পরিমণ্ডলে বসবাস করেও ভারসাম্যপূর্ণ রীতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়। প্রবল বিপত্তি সত্ত্বেও ‘মুসলমান’ পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকাকে তাতাররা গৌরব মনে করেন। আড়াই লাখ তাতার স্বদেশে ফিরে এলেও বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। বাকিদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের পর সেখানে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে কিন্তু একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ক্রিমিয়ার তাতারদের স্বাধীনতা তো দূরের কথা; নিজ মাতৃভূমিতে তাদের প্রত্যাবাসনের কাজটুকু পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি।

জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশন (UNHCR) ক্রিমিয়ায় ফিরে আসা তাতার জনগণের গৃহনির্মাণসহ পুনর্বাসনের জন্য ২.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করলেও আবাসন সমস্যার তীব্রতা হ্রাস পায়নি। বছরের পর বছর ধরে রাশিয়ানরা তাতারদের বাস্তুভিটা ও ব্যবসায়-বাণিজ্য দখল করে রাখার ফলে মূল মালিকরা ফিরে আসতে পারছেন না। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও সংগঠন তাতার মুসলিম ভাইদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছে সোভিয়েত যুগের অবসানের পর। সউদি সরকারের আমন্ত্রণে প্রতি বছর বহু তাতার পবিত্র হজব্রত পালন করে থাকেন। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (IDB) তাতার ভাষা, সাহিত্য ও ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন, নির্বাসিত তাতারদের স্বদেশে পুনর্বাসন এবং ক্রিমিয়ায় একটি ইসলামী সেন্টার স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিয়েছে। তুরস্কের সাথে ক্রিমিয়ার তাতারদের রয়েছে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ক্রিমিয়ায় তুরস্কের ২০টিরও বেশি যৌথ অর্থনৈতিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে এবং তাতার ছাত্রদের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার জন্য তুরস্ক সরকারের রয়েছে অনেক বৃত্তি। স্বদেশে প্রত্যাবর্তিত তাতারদের গৃহনির্মাণ প্রকল্পে অর্থ জুগিয়ে আসছে The Turkish Agency for International Development নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা।

১৯৯৮ সালে এশিয়ান মুসলিম কমিটি, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন করপোরেশন ও জমজম আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশন ক্রিমিয়ার Simferopol জেলার Nizhnegorskoye, Stroganovka ও Rodnikovoye অঞ্চলে তৎপর রয়েছে। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের আগে পুরো ক্রিমিয়ায় মসজিদের সংখ্যা ছিল ১৭৫০, বলশেভিক বিপ্লবের পর তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় মাত্র ১০০-তে। স্থানীয় ও বাইরের মুসলমানদের সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে নতুন মসজিদ, পাঠাগার ও পবিত্র কুরআন শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠছে। তাতার মুসলমানদের ব্যাপক দাবি ও বিভিন্ন মুসলিম দেশের অব্যাহত চাপের মুখে ইউক্রেন সরকার তাতারদের দাবি-দাওয়া পূরণে এগিয়ে আসছে। ক্রিমিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকার বেশ ক’টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব ক্রিমিয়ায় প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের উদ্দেশ্যে ১০ কোটি ডলার ব্যয়ে ১৬৭ মাইল দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতি ও উষ্ণ পানি স্বল্পতার কারণে সৃষ্ট গণদুর্ভোগের অবসান ঘটবে। শত বছরের বঞ্চনা, নিপীড়ন, হতাশা ও ক্ষোভ সত্ত্বেও তাতাররা সহিংসতা ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়নি; বরং নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সমস্যা সমাধানের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আলোর পথে দৃপ্ত পদে এগিয়ে চলেছে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিম জনগোষ্ঠী। মুসলিম উম্মাহর রয়েছে তাদের প্রতি সহানুভূতি।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com