টর্চার সেল আড়াল করতে বাড়ি দখল আ.লীগ নেতার
প্রায় ১১ বছর আগে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পাবনার সাঁথিয়া সরকারি ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক নুরুল ইসলাম এবং ১৫ বছর আগে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য শামসুল ইসলাম বাড়ি করেন সাঁথিয়ার দৌলতপুরে। সারা জীবনের সঞ্চয়ে নির্মিত ওই বাড়ি দুটিই মহাবিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাদের। নবনির্মিত বাড়ি দুটি সাঁথিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তপন হায়দার সানের বাগানবাড়ি লাগোয়া। যেখানে রয়েছে তার টর্চার সেল। সেখানে জনবসতি হলে সব অপকর্ম ফাঁস হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় নুরুল ও শামসুলের পরিবারের ওপর শুরু হয় সান বাহিনীর অত্যাচার। বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে ঘরের মধ্যে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক রেখে পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখানোর পাশাপাশি প্রভাষক নুরুলকে কয়েক দফায় তুলে নিয়ে বেদম মারপিট করে লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় করে সান বাহিনী। মাথায় মদ ঢেলে গায়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টা এবং নুরুলের স্ত্রীকে মারধরসহ সন্তানদেরও হত্যার হুমকি দেওয়া হতো। বাড়ি দুটি নামমাত্র টাকায় কিনে নিতে একইভাবে অত্যাচার চলত শামসুলের পরিবারের ওপর। সান বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নুরুল ও শামসুল নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। নুরুলের বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকলেও শামসুলের বাড়ি দখল করে নিয়ে বসবাস করছে সান বাহিনীর সদস্যরা।
লোমহর্ষক এসব অভিযোগ ছাড়াও এলাকার আরও একাধিক বাড়ি ও জমি দখল, টর্চার সেলে নির্যাতন, চাঁদাবাজি এবং মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তপন হায়দার সানের বিরুদ্ধে। নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিকার চেয়ে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন। এমনকি সম্প্রতি সানের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন খোদ উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। এ পরিস্থিতিতে পাবনার পুলিশ সুপারের নির্দেশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বেড়া সার্কেল) অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছেন। তবে সাক্ষ্য না দিতে তাদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
এই প্রতিবেদক সরেজমিনে গেলে দৌলতপুরে তপন হায়দার সানের বাগানবাড়ির টর্চার সেলের পাশে দখল করা বাড়িগুলোর মালিকসহ নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্তরা সান বাহিনীর ভয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চাননি। তবে পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, কিছুদিন আগে দৌলতপুর গ্রামের সালাম মল্লিক ১৬ শতাংশ জমি ৭৪ লাখ টাকায় কিনলে সালাম ও তার ছেলেকে উঠিয়ে নিয়ে নির্যাতন করে সান বাহিনী। সালাম বাধ্য হয়ে ১১ লাখ টাকার চেক সানের হাতে তুলে দিয়ে মুক্তি পান।
সানের বিরুদ্ধে জমা পড়া লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, দৌলতপুর গ্রামে ইছামতী ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরির মালিক এন্তাজ ও মন্তাজের কাছে চাঁদা দাবি করে না পেয়ে কয়েকবার কারখানা ভাঙচুর, শ্রমিকসহ মালিকদের মারধর করেন সান। এ ছাড়া এন্তাজ ও মন্তাজকে ধরে নিয়ে টর্চার সেলে নির্যাতন চালান। শেষে প্রতি ঈদ উপলক্ষে ও মাসিক চাঁদা দেওয়ার সম্মতিতে এলাকায় ব্যবসা করার সুযোগ পান ওই দুই ব্যবসায়ী। এ ছাড়া দৌলতপুরের সাঁথিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক হারুন অর রশিদ, জালাল উদ্দিন, নুসরাত জাহান কেয়া, উপাধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম, মোবাইল ব্যবসায়ী আবু তালেব, সাঁথিয়া সরকারি ডিগ্রি কলেজের শরীরচর্চ্চা শিক্ষক মুক্তি, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজার নুরুল আমীন, টিনের দোকানদার মোক্তার হোসেন, ভুসি ব্যবসায়ী টোকন, মাটিকাটা সরদার ইসলাম, ছোন্দহ স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক আল হক, চায়ের দোকানদার নুরু, দৌলতপুর স্কুলের শিক্ষক ইমরান, প্রাইমারি শিক্ষক রেজাউল, অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ফিরোজ, ওষুধের দোকানদার মাহতাব ও তার ভাই মাসুদ, বোয়ালমারী কামিল মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ আবু হানিফ, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য শামসুল হকসহ দৌলতপুরের আরও বেশ কিছু মানুষের কাছ থেকে দফায় দফায় চাঁদা নিয়েছেন তপন হায়দার সান।
সানের গোলশানয়ারা মার্কেটের উত্তর পাশে রয়েছে মনমথপুর গ্রামের লিটনের ৭টি দোকান। ওই দোকানগুলো নামমাত্র মূল্যে বিক্রির জন্য লিটনকে চাপ দেন সান। এতে কাজ না হওয়ায় হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ভয়ে লিটন এলাকায় আসতে না পারায় জোর করে এখন ওই সব দোকানের ভাড়া তুলে নিচ্ছেন সান। ওষুধ কোম্পানি হেলথ কেয়ারের এক রিপ্রেজেনটেটিভ ও তার বন্ধুর সঙ্গে সান বাহিনীর তর্ক হয়। এই অজুহাতে দৌলতপুরের একটি চায়ের দোকানের সামনে ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র পকেটে ভরে দিয়ে ভয় দেখিয়ে ওই দুজনের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা চাঁদা নেয় সান বাহিনী।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, সান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরপরই এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ঈশ^রদী বিহারি পল্লী থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের এনে নিজের বাগানবাড়ি ও বাজারে নৈশপ্রহরীর চাকরি দেন। আর এসব কথিত নৈশপ্রহরী উপজেলা সদরসহ সাঁথিয়া এলাকার বাজারগুলোতে ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ করে থাকে। এ ছাড়া এলাকায় নারীঘটিত কোনো ঘটনা ঘটলে সেখান থেকেও চাঁদা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে সানের বিরুদ্ধে।
ধুলাউড়ি কলেজের অধ্যাপক বেলাল হোসেন জানান, দৌলতপুর গ্রামে জায়গা কিনে বাড়ি তৈরির কাজ করতে গেলে সান তাতে বাধা দিয়ে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে রাজমিস্ত্রিদের কাজ না করতে ভয়ভীতি দেখানো হয়। একপর্যায়ে বেলালের স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যার হুমকি দিলে বেলাল ভয়ে জায়গাসহ বাড়ির নির্মাণসামগ্রী নামমাত্র দামে বিক্রি করে পালিয়ে যান।
নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত সাঁথিয়া সরকারি কলেজের প্রভাষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়েছি বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে। বাড়িতে ঢুকে অস্ত্রের ভয়, পতিতা দিয়ে ধর্ষণ মামলার ভয় এবং বাড়িতে প্রবেশের রাস্তা বন্ধসহ মাঝে মাঝেই ভয় দেখিয়ে চাঁদা নিয়েছেন সান।’
আরেক ভুক্তভোগী প্রয়াত শামসুল ইসলামের স্ত্রী নার্গিস আক্তার মিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘সানের কারণেই আমার স্বামীর অকাল মৃত্যু হয়েছে। ওর ভয়ে আমি অন্যত্র বসবাস করছি। আমি এর বিচার চাই।’
এদিকে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্তরা বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের আইজি, রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজিসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে তপন হায়দার সানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। এ ছাড়া সম্প্রতি সানের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কথা জানিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাসান আলী খান, সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল করিম হিরু ও সাঁথিয়া পৌর মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী মাহবুব-উল আলম বাচ্চু প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পাবনার পুলিশ সুপারের নির্দেশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বেড়া সার্কেল) সানের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছেন। তদন্তের অংশ হিসেবে ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ডাকা হয়। আর এ খবর পেয়ে অভিযোগকারী আবদুল হালিম, লিটন, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুর রউফ মোসলেম উদ্দিন, শামসুল ইসলাম ও নুরুল ইসলামকে রাতের অন্ধকারে সান ও তার বাহিনীর সদস্যরা ভয়ভীতি দেখায়। সানের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার সাক্ষ্য দিলে সাক্ষ্যদানকারীর সন্তানদের পিটিয়ে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তপন হায়দার সান বলেন, ‘সব অভিযোগ মিথ্যা, পুলিশ তদন্ত করছে। এ ছাড়া আমার নিজেরই অনেক সম্পদ আছে, আমাকে এসব করতে হয় না। আমি এসব করি না। সব যড়যন্ত্র।’
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বেড়া সার্কেল) শেখ জিল্লুর রহমান বলেন, ‘অভিযোগের তদন্ত চলছে। উভয়পক্ষের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত বলা সম্ভব না।’