চীন ও মুসলিমবিশ্ব: সম্পর্ক কোন দিকে?

0

গত দুই যুগে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বলা যায়, ষোল শতক থেকে বিশ শতক পর্যন্ত উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পরমাণু প্রভুত্বের মাধ্যমে বিশ্বরাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারকারী ঐতিহ্যবাহী পাশ্চাত্য দুনিয়ার শক্তি অধঃপতনের শিকার হয়েছে।

অর্থনৈতিকভাবে বলা যায়, ওই একই পাশ্চাত্য দুনিয়া বৈশ্বিক উৎপাদন ও অর্থনৈতিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে তার অব্স্থান খুইয়েছে। পাশ্চাত্য দুনিয়ার এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভুত্বের এই অবক্ষয়ের সাথে ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকে প্রাচ্যের সমানুপাতিক উত্থান।
চীন তার বিপুল অর্থনৈতিক ও অংশীদারিত্ব কূটনীতির মাধ্যমে অ-পাশ্চাত্য দুনিয়ায় ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রভাব এবং জ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন দিয়ে সভ্যতাগত বিশাল মাত্রায় সুস্পষ্টভাবে প্রাচ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। ফলে, সার্বিকভাবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির কেন্দ্র পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে সরে আসছে, যা বিশ্ব ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে।

ভূতাপেক্ষভাবে প্রতিফলিত এ পরিবর্তন আমাদের মধ্যে বিশ্বাস সৃষ্টি করে যে সভ্যতাগত বৃত্ত আড়াই হাজার বছর আগে তার সূতিকাগার চীন তথা প্রাচ্যে প্রত্যাবর্তন করছে। গত আড়াই হাজার বছর আগের সভ্যতাগত বৃত্তের পুনরাবৃত্তি ঘটলে পরবর্তী সভ্যতাগত প্রার্থী ইসলামি বা মুসলিমবিশ্বের হওয়াটাই যৌক্তিক। আর এর জের ধরেই উদীয়মান বৈশ্বিক চীন ও মুসলিমবিশ্বের মধ্যে ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্বের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
গত ৪০০ বছর ধরে উপনিবেশবাদ ও সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত শোষণের মাধ্যমে মুসলিমবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেছে পাশ্চাত্য। উপনিবেশ-পরবর্তী সময়ে পাশ্চাত্য ও মুসলিমবিশ্বের মধ্যকার সম্পর্কের বৃহত্তর স্বরূপে মুসলিমবিশ্বের ক্ষমতাসীন এলিট ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার সম্পর্কটি অন্তরঙ্গ ও পাশ্চাত্যের প্রতি নির্ভরশীল দেখা গেলেও জনগণ সাধারণভাবে প্রাচ্য (ইসলামি)-মুখীই থেকেছে।

এই বিভাজন আরো বেশি প্রকট হয়েছে গত চার দশক ধরে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনে একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো এবং পাশ্চাত্য-সমর্থিত স্বৈরতান্ত্রিকবাদ থেকে মুক্তি অব্যাহতভাবে প্রত্যাখ্যান করা ও ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্বের সমাধান না করার কারণে। ইসরাইল ও কট্টর আরব রাজতন্ত্রগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকরণের সাম্প্রতিক ধারা এই অঞ্চলের মুসলিমবিশ্বকে নতুন জোট-গঠনের রাজনীতির দিকে চালিত করেছে।
এখন অনিবার্যভাবেই মুসলিমবিশ্ব পাশ্চাত্যের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলার প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য প্রভাবের ক্রমশ অবক্ষয়ের ফলে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। আবার একইসাথে ভেতর থেকেই অর্থনৈতিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও বিকশিত হওয়ার তাগিদ বাইরে থেকে বিশ্বস্ত পৃষ্ঠপোষতকামূলক অংশীদারিত্বের অসন্ধানের প্রেরণা সৃষ্টি করেছে। চীনের উত্থান কি মুসলিমবিশ্বে এ ধরনের অংশীদারিত্বের যোগান দিতে পারবে?
এই প্রশ্নের জবাব হ্যাঁবোধক হওয়ার পক্ষে জোরালো যুক্ত রয়েছে।
প্রথমত, জ্বালানির জন্য চীনের তৃপ্তিহীন পিপাসাই তার মধ্যে সার্বিকভাবে তেল-সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলোর কাছে যাওয়ার তাগিদ সৃষ্টি করবে। চীনের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যচুক্তিগুলো ছাড়াও আরব উপদ্বীপ, ইরান ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামের ওপর চীন ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোও চীনের কাঁচামাল সরবরাহকারী ও শিল্প পণ্যের বাজার। এসব দেশের ওপর নির্ভরশীলতা এসব অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান চীনা বিনিয়োগের সাথে ভারসাম্য বিধান করে।

দ্বিতীয়ত, আফ্রিকা ও এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোতে চীনা অর্থনৈতিক-নীতি সাধারণভাবে ‘অংশীদারিত্ব,’ ‘রাজনৈতিক সাম্যতা,’ ও ‘উইন-উইন সহযোগিতা’ নির্দেশ করে। আর এভাবে চীনা বিনিয়োগ বিবেচিত হচ্ছে অনেক বেশি অনুকূল, তাৎক্ষণিকভাবে কল্যাণমূলক ও অর্থনৈতিক প্রকৃতির। কারণ চীনের বিনিয়োগ ও বৈদেশিক সহায়তায় সাধারণভাবে কোনো রাজনৈতিক পূর্ব শর্তের প্রয়োজন হয় না।
পাশ্চাত্য শক্তিগুলো যেখানে রাজনৈতিক কারণে ইরান, সুদান ও সিরিয়ার মতো দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করছে, সেখানে এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়াই চীনা সহায়তা ও বিনিয়োগ প্রবাহিত হচ্ছে।
অন্য দিকে, চীনা বিনিয়োগ ঘরোয়া বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপহীন-ভিত্তিক। চীনের এই দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়ন ও বন্ধুত্বের নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে মুসলিমবিশ্বে অনেক বেশি জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
তৃতীয়ত, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) চীন ও আঞ্চলিক মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিকশিত করছে। অনেকে মনে করছে, স্নায়ুযুদ্ধ অবসান হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান একতরফাবাদের প্রেক্ষাপটে এসসিও হলো দূরপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব প্রতিরোধ করার একটি প্রয়াস।

ফলে পাশ্চাত্যের সাথে ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক বজায় রেখেই মুসলিম দেশগুলো বিকল্প শক্তিকেন্দ্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তাদের সম্মিলিক শক্তি বাড়ানোর জন্য এসসিওকে আরো বেশি আকর্ষণীয় হিসেবে দেখতে পারে।
চতুর্থত, মুসলিমবিশ্বের অর্থনীতিগুলো বিশাল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে (বিআরআই) এড়াতে বা অগ্রাহ্য করতে পারে না। আর বাস্তবে এটি এশিয়ার সব মুসলিম অর্থনীতিকেই বৃত্তাবত্ত করেছে। সম্মিলিতভাবে এশিয়ার মুসলিম অর্থনীতিগুলোর সবই হয় ধনী বা উন্নয়নশীল। এসব দেশ একইসাথে বিশাল ভোক্তা বাজার ও সেইসাথে কাঁচামালের সরবরাহকারী। ফলে চীনের জন্য এসব দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন সুবিধাজনক। এ কারণে চীন ও এশিয়ার মুসলিমবিশ্ব (অন্তত) বাস্তব কারণেই একে অপরের সাথে লেনদেন এড়িয়ে থাকতে পারে না।
সবশেষ কথা হলো, বৈশ্বিক প্রাচ্য/দক্ষিণে থাকা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অর্থনীতি, জনগণ ও সমাজ বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মঞ্চে বৈশ্বিক প্রাচ্য/দক্ষিণের প্রতিনিধিত্বকারী ব্রিকস উদ্যোগ এড়িয়ে যেতে পারে না।

অন্য দিকে, বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি পরিবর্তনে নেতৃত্ব দানকারী ব্রিকসের উদীয়মান শক্তি জোটকে মুসলিমবিশ্ব অগ্রাহ্য করতে পারে না। ব্রিকস যেহেতু পাশ্চাত্য থেকে সভ্যতাগত বৃত্তের পূর্বমুখী গতিশীলতার প্রতিনিধিত্ব করছে, তাই ভৌগোলিক ও সভ্যতাগত নৈকট্যের কারণেই মুসলিমবিশ্ব ব্রিকসের দিকে এগুতে বাধ্য।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বলা যায়, চীনা সভ্যতা কখনোই মুসলিমবিশ্বের কাছে অপরিচিত ছিল না। বিষয়টি একটি প্রাচীন আরবি প্রবাদবাক্যেও প্রতিফলিত হয়েছে : জ্ঞানের সন্ধানে প্রয়োজনে চীনও যেতে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে চীনের সভ্যতাগত সমৃদ্ধি, জ্ঞান ও উন্নয়নের বাস্তবতাকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে অন্তত জ্ঞান, প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যে হলেও চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক লালন করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

সমসাময়িক কালে সভ্যতাগত বৃত্তের পরিবর্তনে নেতৃত্বাদানকারী শক্তি হিসেবে চীন মুসলিম দেশগুলোর আস্থা অর্জন করছে তাদের ঘরোয়া বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপবাদহীন অবস্থানের কারণে।
সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, পাশ্চাত্যের প্রভাব প্রতিরোধের জন্য একটি বিকল্প পরাশক্তি পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চীনকে ক্রমবর্ধমান হারে গ্রহণ করতে পারে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে সভ্যতার সঙ্ঘাত প্রক্রিয়ায় ইসলামিক-কনফুসিয়ান জোট গঠন নিয়ে হান্টিংটনের ভবিষ্যদ্বাণী ভবিষ্যত হয়তো খুব বেশি উদ্ভট নাও হতে পারে।

অধিকন্তু, ব্রিকস দর্শন বিবেচনা করে বলা যায়, চীন ও মুসলিমবিশ্বের ভবিষ্যত বৈশ্বিক শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আরো ঘনিষ্ঠ সভ্যতাগত অংশীদারিত্ব বিকশিত করার অনেক যৌক্তিক কারণ রয়েছে।
বৈশ্বিক প্রাচ্য/দক্ষিণে মুসলিমবিশ্বের হাতে থাকা ভৌগোলিক এলাকা বিবেচনা করে বলা যায়, ঘনিষ্ঠতর চীন-মুসলিমবিশ্বের সভ্যতাগত অংশীদারিত্ব ভবিষ্যতের সভ্যতাগত বৃত্তের পরিবর্তনের বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য অনেক বেশি অপরিহার্য।

সম্পাদকের নোট : ড. মো. মনিরুজ্জামান, সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া ও অনানারি সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, মুসলিম ওয়ার্ল্ড রিসার্চ সেন্টার (এমডব্লিউআরসি)। এ প্রবন্ধটি মুসলিম ওয়ার্ল্ড রিসার্চ সেন্টারের নেতৃত্বাধীন ‘চায়না অ্যান্ড মুসলিম ওয়ার্ল্ড কো-অপারেশন রিসার্চ: সিএমডব্লিউসিআর’-এর প্রকল্পের অংশবিশেষ। এটি অবশম্ভাব্যভাবে সিজিটিএনের দৃষ্টিভঙ্গি নয়।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com