‘বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেও মেয়েকে বাঁচাতে পারিনি’
‘অনেক শান্ত ছিল আমার মেয়েটি, কিছু পেলেই অনেক খুশি হতো। শান্ত স্বভাবের বলে সবাই তাকে আদর করতো। দুই ছেলে-মেয়ে আর স্বামী সংসার নিয়ে অনেক সুখে ছিলাম। ট্রেন দুর্ঘটনা আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে। মরার আগে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেও মেয়েকে বাঁচাতে পারিনি।’
বুধবার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) বেডে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত নাজমা আক্তার।
এই দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে তার দুই বছর দুই মাস বয়সী মেয়ে আদিবা আক্তার সোহাকে। দুর্ঘটনায় দুই পায়ের হাড় ভেঙে গেছে নাজমা আক্তারের। সব হারিয়ে পঙ্গু হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় মহিলা বেডে শুয়ে অঝরে কেঁদেই যাচ্ছেন।
তিনি জানান, স্বামী-স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ের সংসার ছিল তার। চট্টগ্রাম ইয়ংওয়ান গার্মেন্টে চাকরি করতেন তিনি। স্বামী মহিন আহমেদ সোহেল আরেকটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন। পাশেই একটি ভাড়া বাসায় পরিবারের সবাই থাকতেন। সঙ্গে নাজমার মা রেনু আক্তার (৪৫) থাকতেন। তাদের অনুপস্থিতিতে দুই সন্তানকে দেখাশোনা করতেন তিনি।
নাজমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, দেশের বাড়ি হবিগঞ্জ থেকে কর্মস্থল চট্টগ্রামে ফেরার পথে তার দুই ছেলে-মেয়ে, স্বামী ও তার মা রেনু আক্তার রাত সাড়ে ১২টায় ট্রেনে উঠেন। রাত ৩টার দিকে হঠাৎ বিকট আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসে। মুহূর্তের মধ্যে ট্রেনের বগি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সেসময়ও মেয়ে আদিবাকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে রাখি। কিছুক্ষণ পর দেখি তার শরীর অর্ধেক চাপা পড়ে গেছে। এ সময় বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকি। পরে শুনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি হাসপাতালে মারা যায় সোহা।
গতকাল মঙ্গলবার সুনামগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে তার মেয়েকে দাফন করা হলেও শেষবারের মতো মৃত মেয়ের মুখখানা দেখার ভাগ্য হয়নি তার।
এখনও তার মা রেনু আক্তারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাড়ি থেকে সঙ্গে আনা প্রয়োজনীয় জিনিস, ১৩ হাজার টাকা ও মা ও মৃত মেয়ের শরীরে সোনার অলংকারও খুঁজে পান বলে জানান তিনি।
নাজমা আক্তারের স্বামীর বাম পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। বর্তমানে এই হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার পুরুষ বেড়ে রাখা হয়েছে। চার বছর বয়সী ছেলে নাফিজুল হক নাফিজ ডান হাতে বাধা ব্যান্ডেজ নিয়ে একবার মায়ের বেড়ে আরেকবার বাবার বেড়ে বসে সময় পার করছে, আর নির্বাক হয়ে শুধু এদিক-ওদিন তাকিয়ে দেখছে।
এদিকে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে মাত্র পাঁচ দিন আগেই স্বামীকে হারানো জাহেদা খাতুনের (৪৫) প্রাণ। তবে এখানেই শেষ নয়। তার মা সুরাইয়া খাতুন (৬৫) এবং তিন সন্তানের সবাই আহত হন এই দুর্ঘটনায়।
পঙ্গু হাসপাতালে নাজমা আক্তারের পাশের বেড়ে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন জাহেদা খাতুনের মা সুরাইয়া খাতুন। তার দুই পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। বর্তমানে তার চিকিৎসা চলছে। তবে মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ এখনও জানেন না তিনি।
সুরাইয়া খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, তার বাড়ি আখাউড়া। মেয়ে জাহেদা খাতুনের বিয়ে হয়েছিল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার গাজীপুর এলাকার রামনগরের মুসলিম মিয়ার সঙ্গে। চট্টগ্রামে জাহাজ কাটা শিল্পে কাজ করতেন তিনি। চাকরি সূত্রে বাস করতেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে। মুসলিম মিয়া পাঁচ দিন আগেই মারা যান। সে কারণেই মা সুরাইয়া খাতুন ও সন্তানদের নিয়ে শ্রীমঙ্গল গিয়েছিলেন জাহেদা খাতুন। সেখানে মুসলিম মিয়ার দাফন শেষে সোমবার রাতে সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসে রওনা দেন তারা। ট্রেনে তার সঙ্গে থাকা বাকি সবাই এখন হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
সুরাইয়ার এক স্বজন সানি জানান, জাহেদার আরেক ছেলে সুমনও ট্রেনে ছিলেন তাদের সঙ্গেই। তবে দুর্ঘটনার সময় সে অন্য বগিতে ছিল বলে অক্ষত রয়েছে। এদিন ভোরে তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের সংঘর্ষের এই দুর্ঘটনায় আহত আবুল কালাম, হাসান আলী, ইমন, নিজাম, সোহেল মিয়া , মফিজ ও রায়হানসহ নয়জন ভর্তি হলেও বর্তমানে আটজন চিকিৎসাধীন।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের চিকিৎসক মনি শঙ্কর জাগো নিউজকে বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনার পর আমাদের এখানে ৯ জন রোগী এসেছেন চিকিৎসা নিতে। তাদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে একজন রোগীর মাথায় আঘাতের চিহ্ন থাকায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়। অন্যদের হাত, পা কোমরসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানের হাড় ভেঙে গেছে। সবার চিকিৎসা চলছে। এদের মধ্যে সুরাইয়া খাতুনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিনি বেঁচে গেলেও তার একটি পা কেটে ফেলতে হতে পারে। তবে অন্যরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে আশা করেন তিনি।