বদির নজর টেকনাফ প্রেস ক্লাবে!
সরকারি জমিতে টেকনাফ প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণের ধোয়া তুলে তা বন্ধ করে দিয়েছেন কক্সবাজারের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। স্থানীয় সাংবাদিকদের অভিযোগ, বদি টেকনাফ প্রেস ক্লাবের জায়গা দখলের পাঁয়তারা করছেন। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি দলবল নিয়ে তিনি প্রেস ক্লাব ভবনের সংস্কারকাজ বন্ধ করে দেন। এ সময় পুলিশ ও স্ত্রী শাহিনা আক্তার এমপির উপস্থিতিতে বদি ঠিকাদার ও শ্রমিকদের মারধর করেন। এখন বদির অনুসারীরা প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আবদুর রহমান বদি বলেন, ‘কোনো জায়গা-জমির প্রতি আমার নজর নেই। সরকারি জমিতে টেকনাফ প্রেস ক্লাব গড়ে তোলা হয়েছে। এখন প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে তারা রোহিঙ্গা লালন-পালনে অভিযুক্ত এনজিওদের অর্থায়নে ভবন নির্মাণ করছে। এজন্য আমি তাদের কাজ করতে বারণ করেছি। কিন্তু আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে একটি মহল প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে।’
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রেস ক্লাব কর্র্তৃপক্ষ এনজিওর অর্থায়নে ভবন সংস্কারের জন্য অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিল। আমি সংশ্লিষ্ট এনজিওকে সুপারিশ করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘টেকনাফ প্রেস ক্লাবের জায়গাটি খাসজমি। তবে প্রেস ক্লাব দীর্ঘদিন ধরে এটি ব্যবহার করে আসছে বলে আমি জানি।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন থেকে থানাসংলগ্ন স্থানে টেকনাফ প্রেস ক্লাবের কার্যক্রম চলে আসছে। এখানে একটি এনজিওর মাধ্যমে ভবন নির্মাণের কাজ চলছিল। কিন্তু গত ২২ নভেম্বর দলবল নিয়ে তা বন্ধ করে দেন আলোচিত-সমালোচিত সাবেক এমপি বদি। প্রশাসন থেকে অনুমতির কথা বললেও তিনি শোনেননি। পুলিশের সামনেই কাজ বন্ধ করে দেন।
সাংবাদিক নেতারা জানান, সব ধরনের নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে ১৯৯৬ সালে টেকনাফ থানা পরিষদ বা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবর তৎকালীন পরিত্যক্ত অফিসার্স ক্লাবটি টেকনাফ প্রেস ক্লাবের নামে বরাদ্দ দেওয়ার আবেদন করেন তারা। এ পরিপ্রেক্ষিতে থানা/টেক/৫৩৩/বিবিধ/স্মা: ৯৬ তারিখ-৩০/০৯/৯৬ মূলে এটি বরাদ্দ দেন তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা। তবে ওই সময় পৌরসভা গঠিত হয়নি। তাছাড়া ওই সময় আশপাশে প্রেস ক্লাব ও টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের সেমিপাকা ভবন ছাড়া কোনো স্থাপনা ছিল না।
একসময় টেকনাফ সদরের অংশ বিশেষকে পৌরসভা ঘোষণা দেওয়ার পর ২০০১ সালের ২২ জুন ভবনের অনুমতি বা বরাদ্দ পেতে আবারও তৎকালীন টেকনাফ পৌর প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করে প্রেস ক্লাব কর্র্তৃপক্ষ। পরে টেকনাফ পৌরসভার স্মারক নং-১২২ (১.৭.২০০১) মূলে ভবনটি টেকনাফ প্রেস ক্লাবের জন্য বরাদ্দের অনুমতি দেয় প্রশাসন। বরাদ্দের পর থেকে তৎকালীন এমপি, জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নানাভাবে সহায়তা করে আসছে। এমনকি আবদুর রহমান বদি নিজেই ভবনটি ব্যবহার করতে নানাভাবে আশ্বাস দেন। কিন্তু এখন তিনিই প্রেস ক্লাবের জায়গাটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন একাধিক সাংবাদিক নেতা।
স্থানীয়রা জানায়, গত ২৮ অক্টোবর জরাজীর্ণ প্রেস ক্লাব ভবন সংস্কারের জন্য ইউএনএইচসিআরের এনজিও ফোরাম নামে একটি এনজিও কাজ শুরু করে। আর এ কাজে বরাদ্দ ধরা হয় ২২ লাখ টাকা। সংস্কারকাজের তদারকিতে আছেন প্রকৌশলী মহিউদ্দিন নাঈম। সবমিলে ৮-১০ শ্রমিক কাজ করেন ভবনটিতে। গত ২২ নভেম্বর সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি দলবল নিয়ে ঠিকাদারসহ অন্যান্য শ্রমিককে মারধর করে তাড়িয়ে দেন। এ সময় তার স্ত্রী শাহিন আক্তার এমপি ও পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ওইদিন প্রেস ক্লাবসংলগ্ন টেকনাফ পৌরসভার রাস্তা, ড্রেন, কালভার্ট ও সড়ক নির্মাণকাজের উদ্বোধন করতে যান এমপি শাহিনা আক্তার ও তার স্বামী আবদুর রহমান বদিসহ অন্যরা। উদ্বোধন শেষে ফেরার পথে প্রেস ক্লাবের ভবনে কাজ চলমান দেখে ক্ষিপ্ত হন। নিজে সেখানে গিয়ে সংস্কারকাজ চলছে মর্মে লেখা ডিজিটাল ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন। পরে তিনি প্রেস ক্লাবের ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় তিনি তার চাচা পৌর মেয়র হাজি ইসলামকে ভবনটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন।
প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক মো. সৈয়দ হোসেন বলেন, ‘স্বামীর এমন কাণ্ডে এমপি শাহিনা আক্তার নিজেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ভবন সংস্কারের কাজ চলছিল। গত ১৬ সেপ্টেম্বর সংস্কার করতে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলামের কাছে আবেদন করা হয়। তার সুপারিশ নিয়ে আমরা ইউএনএইচসিআরের কক্সবাজারের সহকারী পরিচালকের সঙ্গে দেখা করি। তারা অর্থায়ন করার অনুমতি দিলে কাজ শুরু হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৯৯৩ সাল থেকে প্রেস ক্লাবটি আমরা ব্যবহার করে আসছি। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ৪০ জন। বদি ও তার লোকবলের হামলায় ঠিকাদারসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিক আহত হন। বর্তমানে নির্মাণকাজ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। তারা আমাদের হুমকি দিচ্ছে। প্রাণনাশের আশঙ্কা করছি। প্রেস ক্লাবটি কোনো অবৈধ নয়। ঘটনার পর টেকনাফ প্রেস ক্লাব কর্র্তৃপক্ষকে বসার আমন্ত্রণ জানান বদি। তার বাসায় আমরা কয়েক দফা গিয়ে বৈঠকও করেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রেস ক্লাবের ২ শতাংশ জায়গাটি দখলে নিতে বদি ও তার লোকজন নানাভাবে পাঁয়তারা করছেন। বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। এখন আমরা প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন গতকাল বলেন, ‘টেকনাফ প্রেস ক্লাবের জায়গা, সেখানে কারা ভবন নির্মাণ কিংবা সংস্কার করছে, তার কিছুই আমি জানি না। তাছাড়া সাবেক এমপি বদি কিংবা তার লোকজনের হামলার বিষয়ে কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করেনি।’
এ বিষয়ে আবদুর রহমান বদি বলেন, ‘সরকারি জায়গা দখল করে প্রেস ক্লাব কর্র্তৃপক্ষ অনুমতি ছাড়াই ভবন নির্মাণ করছে। আমি তাদের কাজ করতে বারণ করেছি। তাছাড়া যে এনজিও এ কাজে অর্থায়ন করছে, তাদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের নানাভাবে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। আমিই তো সাংবাদিক নেতাদের বলেছি আপনারা আমার জমিতে আসেন, নিজে ভবন করে দেব। কিন্তু আমি কখনো সরকারি জায়গায় ভবন করতে দেব না। বড় কথা ওই জায়গার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই।’