ইরান-সৌদি সম্পর্ক কোন দিকে নিয়ে যাবেন বাইডেন

0

ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব হওয়ার পর থেকে এর বিরুদ্ধে মার্কিন-ইসরাইল এবং আরব দেশগুলোর বৈরিতা ছিল লক্ষণীয়। এর অংশ হিসেবে বিপ্লবোত্তর ইরানে ব্যাপক অন্তর্ঘাতী ঘটনা ঘটে, ইরাক-ইরান দশকব্যাপী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইরান বিপ্লব রফতানির ঘোষণায় রাজতান্ত্রিক উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে আতঙ্কিত প্রতিরোধ প্রয়াস লক্ষ করা যায়। যা অনেক সময় জাতিগত ও রাষ্ট্রগত প্রতিহিংসা পদক্ষেপ পর্যন্ত গড়ায়। এই দ্বন্দ্ব সংঘাতের পথ ধরে গত দুই দশকে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ভাঙচুর ও মেরুকরণের সৃষ্টি হয়। এই মেরুকরণে ইরানের দৃশ্যমান প্রতিপক্ষে পরিণত হয় একইসাথে উপসাগরীয় আরব দেশগুলো এবং ইসরাইল। লক্ষ্য নির্ধারণের মাত্রায় ইরানের সামনে ইসরাইলের চেয়েও তাৎক্ষণিক প্রতিপক্ষে পরিণত হয় উপসাগরীয় আরব দেশগুলো, বিশেষত সৌদি আরব। এর মধ্যে ২০০২ সালে তুরস্কে ক্ষমতায় আসে ইসলামী পটভূমি থেকে গঠিত রক্ষণশীল দল একে পার্টি। দলটির নেতা রজব তাইয়েব এরদোগান তুরস্কের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করার পাশাপাশি পররাষ্ট্র সম্পর্কে প্রভাব সম্প্রসারণের প্রতি মনোযোগী হন।

এ দিকে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হতে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তায় সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব কমতে থাকে। ওবামা-বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে একনায়ক শাসিত দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রতি সমর্থন দেন একপর্যায়ে। এর ফলে আরব বসন্তের জের ধরে একাধিক আরব একনায়কের পতন ঘটে। সৌদি আরবসহ বেশ কিছু আরব দেশের রাজতন্ত্র হুমকিতে পড়ে যায়। গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্য ভূমিকা নেন তুরস্কের এরদোয়ান। এই পরিস্থিতিতে আরব শাসকদের অধিকাংশ এবং ইসরাইল ইরানের চেয়েও তুরস্ককে বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে। আর মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় আন্দোলন হিসেবে মুসলিম ব্রাদারহুডকে প্রধান প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করে এই শক্তিটিকে দমন করার তৎপরতায় লিপ্ত হয়। মিসরে মুরসির নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সিসির সামরিক অভ্যুত্থান এবং পরে ব্রাদারহুডের উপর গণহত্যার মতো নির্বিচার দমন পীড়ন, সিরিয়ার বিদ্রোহীরা জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার পর রাশিয়ার বিমান আক্রমণ ও ইরান সহায়তাপুষ্ট হিজবুল্লাহর অভিযানে একবারেই তিন লাখ সিরীয় নিহত হওয়া এবং লিবিয়ায় খলিফা হাফতারকে দিয়ে রাষ্ট্র দখলের প্রচেষ্টার সাথে এর যোগসূত্র রয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে আরব রাজতন্ত্রগুলোর সামনে একই সাথে দু’টি মুসলিম প্রতিপক্ষ হাজির হয়। এর একটি হলো শিয়া রাষ্ট্রশক্তি ইরান আর অন্যটি হলো মধ্যপন্থী সুন্নি রাষ্ট্রশক্তি তুরস্ক। এ সময়ে উগ্র ইসরাইল বান্ধব ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রশাসন আরব রাষ্ট্র ও সরকারগুলোর নিরাপত্তা প্রদানের জন্য ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ব্যবস্থাপত্র প্রদান করে। গোয়েন্দা সমন্বয় ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থাপত্র বাস্তবায়ন চলে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম কয়েক বছর। এ সময় আরব-ইসরাইল আলোচনার প্রক্রিয়া থেকে ফিলিস্তিনকে বিদায় করা হয়। শেষ পর্যন্ত আরব ইসরাইল আলোচনায় ফিলিস্তিন ইস্যু গৌণ হয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। আরো কয়েকটি আরব দেশের নাম এই প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

এর মধ্যে জো বাইডেনের আমেরিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার পর অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইল লবি আইপ্যাকের সাথে জো বাইডেনের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। তার বর্তমান স্ত্রীও একজন ইহুদি। তিনি গত ১৩ আগস্ট ইসরাইয়ল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যকার সম্পর্ক সাধারণীকরণ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ যা উত্তেজনা ও মধ্যপ্রাচ্যের গভীর বিভাজনে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে সহায়তা করবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদানকে সাহসী কাজ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তদুপরি, এমন কোনো লক্ষণ নেই যে বাইডেন প্রশাসন এই চুক্তিগুলোর (বাহরাইন এবং সুদান সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্ব অনুসরণ করেছে), ধারাবাহিকতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। তবে উদার চিন্তা চেতনার নেতা জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র ধরনের ইসরাইল বান্ধব নীতি থেকে সরে আসতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি জবরদস্তি কোনো সমাধান চাপিয়ে দেয়ার পরিবর্তে সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে আরব ইসরাইল একটি সমাধান চাইবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি খবরের উপর দৃষ্টি রাখলে মধ্যপ্রাচ্যে ভেতর থেকে কিছু পরিবর্তন ঘটার বিষয় দৃশ্যপটে আসতে পারে। দুই সপ্তাহ আগের খবর ছিল সৌদি আরব তুর্কি পণ্য বয়কটের একটি অনানুষ্ঠানিক তৎপরতা শুরু করেছে। অন্য দিকে খাগোশি হত্যাকা-ের মামলা চাঙ্গা করার খবর আসে তুরস্ক থেকে। একই সাথে সৌদি দরবারি আলেমদের সংগঠন স্কলার্স ফোরাম মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত হিসেবে বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখান থেকে ধারণা তৈরি হয় যে তুরস্ক-সৌদি সম্পর্কের অবনতি ঘটতে চলেছে।

এর মধ্যে খবর আসে সৌদি বাদশাহ সালমানের সাথে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব এরদোগানের লম্বা টেলিফোন সংলাপ হয়েছে। এই আলোচনায় তুর্কি পণ্য বর্জনের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে এবং দুই দেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য পরস্পরের সাথে আলোচনার কথা বলা হয়েছে। একই সময়ে আরো দু’টি খবরের একটি হলো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা দেয়া হলেই সৌদি আরব ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয় বিবেচনা করবে। আর কাতারকে বয়কট করার বিষয়টির অবসান কিভাবে করা যায় সে বিষয়টি ভাববে রিয়াদ।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com