অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ আওয়ামী লীগ নেতার
বাগেরহাটের পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক খান হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। চাকরি বিধিমালা উপেক্ষা, মানবিক বিষয় উল্লেখ করে রাজস্ব খাতে নিয়োগ, দোকান ও চান্দিনা ভাড়ায় অনিয়ম, জামানতের টাকা আত্মসাৎ, দরপত্রে জালিয়াতি, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পিএফ ও গ্র্যাচুয়িটি ফান্ডের টাকা না দিয়ে টালবাহানা, টেন্ডার দিয়ে কাজ না করে অর্থ আত্মসাৎ এবং হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকা পৌর তহবিলে জমা না দিয়ে আত্মসাৎসহ মেয়রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এখন পৌরবাসীর মুখে মুখে। এ পরিস্থিতিতে হাবিবুর রহমানের দুর্নীতির খোঁজে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের খুলনার সহকারী পরিচালক তরুণ কান্তি ঘোষকে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
হাবিবুর রহমানকে গত ২৫ অক্টোবর খুলনা দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংশ্লিষ্ট সব নথিপত্র জমার জন্য নোটিস দেওয়া হয়েছিল। গত ৭ অক্টোবর ওই নোটিসটি মেয়র বরাবর পাঠানো হয়। কিন্তু নোটিস পাওয়ার পর প্রায় দেড় মাস পার হতে চললেও বেশিরভাগ কাগজপত্র এখনো জমা দেননি মেয়র। উল্টো ওই চিঠি পাওয়ার পর দুর্নীতির প্রমাণ মুছে ফেলতে তিনি নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পৌরসভার একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন।
বাগেরহাট পৌরসভার একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, জেলার অন্যতম ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরুর বিষয়টি বেশিরভাগ পৌরবাসী ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। আর এতে রাজনৈতিকভাবে মেয়রসহ তার অনুসারীরা অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। দুদকের চিঠি পাওয়ার পর থেকে পৌরসভায় ব্যতিব্যস্ত রয়েছেন মেয়র ও তার অনুগত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে যাতে কোনো চিহ্ন না থাকে এবং কোনো তথ্য যাতে বাইরে যেতে না পারে বিশেষ করে সাংবাদিকরা যাতে তথ্য পেতে না পারেন সেজন্য সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র।
মেয়রকে পাঠানো দুদকের নোটিসে বলা হয়েছে, পৌরসভার মালিকানাধীন দোকানঘর, চান্দিনা (মাছ ও সবজি বিক্রেতাদের বসার জায়গা) এবং দশানী পৌর পার্ক ভাড়ার জামানত থেকে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা গ্রহণ করা হলেও তা পৌর তহবিলে জমা দেওয়া হয়নি। রোলার ভাড়ার টাকাও আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর বাইরে পৌরসভার দরপত্রে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাবু, ইসরাফিল ও আবু দাউদ নামে তিন ব্যক্তির ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে পৌরসভার কোটি কোটি টাকার কাজ মেয়রের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় দুর্নীতির ক্ষেত্রটি হচ্ছে হোল্ডিং নম্বর প্রদান থেকে পাওয়া রাজস্ব আত্মসাৎ। কারও নতুন কেনা জমিতে হোল্ডিং নম্বর দিতে গেলে পৌরসভার হোল্ডিংয়ের মালিকের কাছ থেকে জমির দলিলে উল্লিখিত মূল্যের শতকরা দুই টাকা হিসেবে জমা নেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু শতকরা ওই টাকা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নগদে নিয়ে ব্যাংকে জমা না করে পকেটস্থ করছেন মেয়র।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও দুদক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাগেরহাট পৌরসভায় জনবল নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোনো ধরনের ছাড়পত্র না নিয়েই রাজস্ব খাতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১৩ জন কর্মচারীকে। ২০১৭ ও ’১৮ সালে তিনটি রেজুলেশনে মানবিক কারণ দেখিয়ে এসব নিয়োগ দিয়েছেন পৌর মেয়র। শুধু তাই নয়, এসব নিয়োগপ্রাপ্তরা জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এর আগে ২০১৭ সালে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ছয়জনকে।
পৌরসভার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দুদকের চিঠি পাওয়ার পর অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া ছয়জনকে কাগজে-কলমে বাদ দেখানো হয়েছে। তবে তারা পৌরসভার বিভিন্ন কাজে ঠিকই নিয়োজিত রয়েছেন। আবার এসব কর্মচারী যাতে কারও কাছে মুখ না খোলে তার জন্য শাসিয়েছেন পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান। দেখানো হয়েছে ভয়ভীতিও। ভয়ে তারা অপরিচিত কারও সঙ্গেই কথা বলতে চাইছেন না। এছাড়া পৌরসভার বিভিন্ন অনিয়মিত ফান্ডের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কিছু টাকা সমন্বয় করার কাজও চলছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, বাগেরহাটের দশানী ক্রস রোডের সড়ক নির্মাণের জন্য দুই দফায় ৪৪ লাখ টাকা ছাড় করানো হয়। ওই সড়ক নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও কাজ না করে সম্পূর্ণ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এর বাইরেও বাগেরহাট পৌরসভার বিভিন্ন সড়ক উন্নয়নের নামে নিজের আত্মীয়স্বজন ও বিশেষ সুবিধাভোগী ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ না করেই কাগজে-কলমে কাজ হয়েছে দেখিয়ে বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আর এসব দুর্নীতিতে দুই আস্থাভাজন কর্মকর্তা মেয়রকে সবসময় সহায়তা করছেন। জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে নিজেকে তুলে ধরতে খানজাহান আলী মাজার গেট নির্মাণ ব্যয় পৌর তহবিল থেকে জোগানো হয়। এ গেট নির্মাণেও হয়েছে ব্যাপক অনিয়ম।
দুদকের খুলনার কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মেয়র অল্প কিছু কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। প্রায় এক মাস পার হতে চলল কিন্তু বাকি কাগজের কোনো খবর নেই।’
দুদকের খুলনা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নাজমুল হাসান বলেন, ‘আমি ছুটিতে আছি। তাই পুরো বিষয়টি জানি না। তবে তিনি (মেয়র) নির্দিষ্ট সময়ে যদি কাগজপত্র জমা না দেন তবে তাকে তিনবার সুযোগ দেওয়া হবে। এর মধ্যে তিনি কাগজপত্র জমা দিতে ব্যর্থ হলে দুদকের আইন অনুসারে মামলা হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র খান হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সামনে নির্বাচন তাই প্রতিপক্ষরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও মিথ্য অভিযোগ দিয়ে সুবিধা আদায়ের জন্য চেষ্টা করছে। দুদক চিঠি দিয়ে যেসব কাগজপত্র ও ডকুমেন্ট চেয়েছে তা দিয়েছি। এখন তারা এ বিষয়ে তদন্ত করবে। তারপরও তারা যদি আরও কিছু চায় তা যদি আমার কাছে থাকে তাও দেব। তারা স্বাধীনভাবে তদন্ত করুক, আমি দোষী হলে আমার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেবে তাই হবে। তবে আমি বিশ্বাস করি এতে আমার কিছু হবে না।’
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.