বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে সরকার ও ইসলামপন্থিরা মুখোমুখি
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু মহাসড়কের গোড়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। কিন্তু নির্মাণের আগেই ইসলামপন্থী কয়েকটি দল এর বিরোধিতা করছে। তারা বলছেন, ভাস্কর্যের নামে মূর্তি সংস্কৃতি এদেশে চালু করা যাবে না। জবাবে সরকার মহল থেকেও আসছে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন ইসলামপন্থীদের ঘাড় মটকে দিবে! কেউ বলছেন বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে কোনো অর্বাচীনের কথা গ্রহণযোগ্য হবে না। ইসলামপন্থিরা চাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ না করতে। সরকার চাচ্ছে যে কোনো মূল্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করতে। সরকার ও ইসলামপন্থীদের এই মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে আজকের প্রতিবেদন।
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ।।
চলমান ভাস্কর্য ইস্যু নিয়ে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, এদেশের আলেমরাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকৃত হিতাকাঙ্খী। কেননা আমরা আলেমরা চাই না যে, ‘যিনি আমাদের এ দেশ স্বাধীন করে দিয়েছেন, তার কবরে এ ভাস্কর্য উসিলা করে আজাব হোক।’
তিনি বলেন, ভাস্কর্য ও মূর্তির মাঝে কোন পার্থক্য নেই। স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি, এ দুটি এক ও অভিন্ন। যে কোনো ভাবে কোন মানুষের আকৃতিকে কোন কিছুর মাধ্যমে যদি এমনভাবে দাঁড় করানো হয়, যেটার ছায়া পরে। তাকেই ইসলামে মূর্তি বলে। চাই মানুষ এর পূজা করুক আর নাই করুক। সেটা মানুষ স্মৃতি ধরে রাখার জন্য বানাক কিংবা পূজা করার জন্য বানাক।
তিনি বলেন, আমরা উলামায়ে কেরামগণ এই ভাস্কর্য বা মূর্তির বিরোধিতা করছি কোন বিদ্বেষের কারণে নয়। কিংবা কারো পক্ষ নিয়ে নয়। আমি স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, উলামায়ে কেরামের বক্তব্যকে বিকৃত করে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চান তারা সাবধান হয়ে যান। আমরা উলামায়ে কেরামগণ মন উজাড় করে বলে দিতে চাই, যদি দেশের জন্য প্রয়োজন হয় নিজের তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিব। যদি প্রয়োজন হয় যুদ্ধ জিহাদ করব। এমনকি ওলামায়ে কেরাম সেই জিহাদের প্রথম কাতারে থাকবেন। কিন্তু দেশপ্রেমের কথা বলে আমরা মূর্তির পক্ষপাতিত্ব করতে পারবো না।
মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীম।।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর সিনিয়র নায়েবে আমির চরমোনাই’র পীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীম গত শুক্রবার (১৩ নভেম্বর) ভাস্কর্য নির্মাণের স্থল ঢাকার ধোলাইপাড় এলাকায় এক সমাবেশে বলেছেন, ‘ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের চক্রান্ত তৌহিদি জনতা রুখে দেবে। রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে মূর্তি স্থাপনের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে ফিরে আসতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তৌহিদি জনতার আন্দোলন চলবে। সরকার যদি ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন থেকে সরে না আসে, তাহলে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো। এরপর দেশের যে কোনো পরিস্থিতির জন্য সরকারকেই দায়ভার নিতে হবে।’
মুফতি আব্দুল মালেক।।
এক দীর্ঘ প্রবন্ধে মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার আমিনুত তালীম মুফতি আব্দুল মালেক লিখেছেন, ‘মূর্খ লোকেরা তাদের উপাস্যদের ও বরেণ্য ব্যক্তিদেরই ভাস্কর্য তৈরি করে থাকে। কিন্তু চিন্তাশীল মানুষ এ প্রসঙ্গে কোন বিষয়টা বিবেচনা করবেন-কে ভাস্কর্য নির্মাণ করল, না কার ভাস্কর্য নির্মাণ করা হল?
উলামায়ে কেরাম স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, পূজার মূর্তি দুই কারণে নিষিদ্ধ। ১. প্রাণীর প্রতিকৃতি। ২. পূজা, আর সাধারণ ভাস্কর্য প্রাণীর প্রতিকৃতি হওয়ার কারণে অবৈধ। পূজা শুধু মূর্তিরই হয়নি, বিভিন্ন বস্তুরও হয়েছে। সেগুলোর ভাস্কর্য তৈরি করাও নিষিদ্ধ-হারাম। এটা পূজার কারণে। যদিও তা প্রাণীর প্রতিকৃতি নয়। তদ্রূপ ছবি বা মূর্তির পিছনে কখনো শুধু সৌন্দর্যই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এটা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ প্রাণীর প্রতিকৃতি। আবার কখনো স্মরণ ও সম্মানের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। এটা যেমন প্রাণীর প্রতিকৃতি হওয়ার কারণে হারাম তেমনি এ কারণেও যে, এভাবে কোনো প্রতিকৃতির সম্মান দেখানো এক ধরনের ইবাদত বলেই গণ্য।
মাওলানা মামুনুল হক।।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক ঢাকার বিএমএ মিলনায়তনে খেলাফত যুব মজলিস ঢাকা মহানগরীর এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে তারা বঙ্গবন্ধুর সু-সন্তান হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন মুসলিম হিসেবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর মূর্তি তৈরি করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্থাপন করা হলে তা হবে বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে বেইমানি।’
মাওলানা গাজী আতাউর রহমান।।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘ভাস্কর্য আর মূর্তি একই। ইসলামে মূর্তি স্থাপন হারাম। তারপরও সরকার যদি বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন করে তবে তৌহিদি জনতা তা মেনে নেবে না।’
তবে আলেম হয়েও বিপরিত মন্তব্য করেছেন, ওলামা লীগের মহাসচিব মাওলানা আবুল হাসান শাহ শরিয়তপুরী। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ইসলামে কোনো সমস্যা নাই। এটা সবাই দেখবে সেই জন্য বানানো হচ্ছে। হেফাজত ও জামাত শিবির এর বিরোধিতা করছে। তারা অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানানো হচ্ছে, সেটা হোক। কোরানের আয়াত দিয়ে অন্য জায়গায়ও বানানো যাবে। এটা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করার কোনো দরকার নাই।’
এ বিষয়ে সরকার পক্ষ থেকে অনেকেই বক্তব্য দিয়েছেন। কারো বক্তব্য স্বাভাবিক হলেও আওয়ামী লীগের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল আলেমদের উদ্দেশ করে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, ‘যতটুকু বলেছেন ক্ষমা চেয়ে সাবধান হয়ে যান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করলে ঘাড় মটকে দেবো।’
এদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রয়ে সয়ে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে ইসলামি সংগঠনগুলোর আপত্তির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’
আর মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ বিষয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। যারা এই ভাস্কর্য পছন্দ করেন না, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংবিধান এবং আইনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। বাংলাদেশ কোনো মৌলবাদী গোষ্ঠীর আস্ফালনের জায়গা নয়।’
ওদিকে ইসলামপন্থিদের এ দাবিকে কোনো গুরুত্ত্ব না দিয়ে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘ওদের তো এই শিক্ষা নেই। ওরা কী বলল তাই তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেশের স্বাধীনতা ও ইতিহাসের অংশ। এই প্রজন্ম ভাস্কর্য দেখে শিখবে। ইতিহাস জানবে। এটা মূর্তি কেন হবে? এখানে তো কেউ পূজা করতে যাবে না। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে কোনোভাবে আশকারা দেওয়া ঠিক হবে না।’
এদিকে গত বুধবার বিআইডব্লউিটিএ’র নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের ভিআইপি জেটিতে সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘কোনো অর্বাচীনের কথায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণকাজ বন্ধ করা হবে না। সারা দেশে জাতির পিতার অসংখ্য ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। পথেঘাটে কে কী বলল, তা নিয়ে গুরুত্ব দেয়ার কোনো কারণ নেই। বর্তমান সরকার যে কথা বলে, তা বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা নিয়েই বলে।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ইয়েমেন, পাকিস্তানসহ সকল মুসলিম দেশেই তাদের দেশ ও জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে বহু ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান আসলে বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিরুদ্ধেই অবস্থান। পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ধর্মভিত্তিক দল ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের আসল টার্গেট সহশ্রাব্দের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা। ৭৫ এর পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার যে রাজনীতি শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধীতা সেই রাজনীতিরই অংশ।’