বিএনপি নিয়ে কিছু প্রশ্ন কিছু উত্তর

0

বিএনপি কেন আন্দোলন করছে না? বিএনপি কি আদৌ আন্দোলন করবে? করলে সেটা কবে? বিএনপি নতুন নির্বাচন কেন চাচ্ছে? নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনার পরও বিএনপি কেন সংসদে গেল? বিএনপি একটির পর একটি নির্বাচনে কেন অংশ নিচ্ছে? বিএনপি কি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে? বিএনপি কি মিডিয়াকেন্দ্রিক রাজনীতি করছে? সরকারের সব কাজের সমালোচনা করা বিএনপি কি সরকারের উন্নয়ন দেখতে পায় না? বিএনপি কার নির্দেশে পরিচালিত হয়?

সরকারি দলের নেতানেত্রী থেকে শুরু করে যে কোনো টকশো, আড্ডায় ঘুরেফিরে এই প্রশ্নগুলো বারবার করা হয়। আমি জানি এই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নকর্তার কাছে স্পষ্ট থাকার পরও করা হয় শুধু বিএনপিকে বিব্রত করার চেষ্টায়। রাইটার্স প্রেমিসেস থেকে একজন লেখকের না লেখা কিন্তু বোঝাতে চাওয়া বক্তব্য যেমন পরিস্কার হয়ে ওঠে, তেমনি স্পিকার্স প্রেমিসেসও জানিয়ে দেয় তার প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অর্থটি কী। যে মানুষটি ভুলেও কখনও ২০১৪ সালের নির্বাচন, ১৫৩টি আসনে কোনো নির্বাচন না হওয়া, ২০১৪ সালে ‘নিয়ম রক্ষার’ নির্বাচনের পর দ্রুত আরেকটি নির্বাচন দেওয়া হবে- আওয়ামী লীগের এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা নিয়ে একটি প্রশ্নও কোথাও তোলে না, সেও অতি চিন্তিত মুখে টকশো, সুধী সমাবেশে বসে বিএনপিকে উচিত-অনুচিত এর সবক দেয়।

রাজনীতির কিছু খোঁজখবর রাখে এমন প্রতিটি ব্যক্তি জানে বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ কতটা রাজনীতিশূন্য হয়ে পড়েছে। সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ যেহেতু বিএনপি, সেহেতু গত ১৩ বছর ধরে বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার এবং পারলে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে ক্ষমতাসীন দলটি। এক-এগারোর সরকারের সময় মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেখানে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছিল মাত্র চারটি মামলা, এই সরকারের ১২ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬টিতে। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপির অ্যাক্টিং চেয়ারম্যানের দেশে ফেরার অবস্থা নেই। বিএনপি মহাসচিবের বিরুদ্ধে আছে ৮৬টি মামলা। স্থায়ী কমিটির প্রতিটি সদস্য থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত ৩৫ লাখ কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে আছে লক্ষাধিক মামলা। বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা হয়েছেন গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার। তার পরও বিএনপিকে ভাঙা যায়নি। এটাই বিএনপির সবচেয়ে বড় সফলতা, সবচেয়ে বড় শক্তি। দ্বিদলীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার মতো যদি কোনো দল থাকে, তবে সেটা বিএনপি।

বিএনপি কেন আন্দোলন করছে না সেটা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকার সমর্থক কিছু বুদ্ধিজীবী হাসি হাসি মুখে প্রশ্ন তোলেন। বিএনপিকে যদি কেবল আওয়ামী লীগ মোকাবিলা করতে হতো, আমি নিশ্চিত হাসি হাসি মুখে এই প্রশ্ন তুলতেন না। কিন্তু দুর্ভাগ্য জাতির, প্রধান বিরোধী দলটিকে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে হয়।

সুতরাং প্রবল ক্ষমতাধর একটি সরকারকে বিএনপির মতো মধ্যপন্থি গণতান্ত্রিক একটি দলের পক্ষে দিন-ক্ষণ-তারিখ ঘোষণা করে হটিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। যারা এ ধরনের প্রশ্ন করেন, কবে আন্দোলন করবেন বলে ট্রোল করেন, তারা বস্তুত জেনেশুনে ক্ষমতাসীন কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারকে শক্তি জুগিয়ে যান।

মধ্যবর্তী নির্বাচন না চেয়ে নতুন নির্বাচন কেন চাচ্ছে বিএনপি, সেটা বিএনপি মহাসচিব খুব যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা তো এ কথা (মধ্যবর্তী) বলিনি। আমরা গত নির্বাচন যেটা হয়েছে, সেটাই তো মানছি না। আমরা ওটাকে অবৈধ বলছি, আমরা ওটাকে বাতিল করার কথা বলছি। আমাদের প্রত্যেকটি স্টেটমেন্টে এ কথা বলেছি যে, ওই নির্বাচন আমরা মানি না, ওটা বাতিল করে ফ্রেশ নির্বাচন দেওয়া হোক।’

বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব সমস্যা দেখা যাচ্ছে, তার অনেকগুলো অতীতে ছিলই না, আবার অনেকগুলো যে মাত্রায় এবং তীব্রতায় ঘটছে, অতীতে কখনও তার কাছাকাছি মাত্রায়ও ছিল না। প্রতিটি ঘটনা যা আলোচিত হলো, তার সবই হলো উপসর্গ। মূল রোগ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়া। তাই এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলাই যায়, অতি দ্রুত একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া এই দেশ কোনোভাবেই আর সঠিক পথে আসবে না। এটা এই দেশের জনগণেরই চাওয়া।

বিএনপির সংসদে যোগ দেওয়া নিয়ে ঘরে-বাইরে ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংসদে তারা যোগ দিয়েছে। যেখানে ঘরোয়া সভায় পর্যন্ত পুলিশের বাধা এবং নজরদারি থাকে সেখানে সম্ভবত এই বিবেচনায় সংসদে গেছে যে সেখানে গিয়ে তারা অন্তত দেশের কথা, দলের কথা বলতে পারবে এবং যৌক্তিকভাবে সরকারের সমালোচনা করতে পারবে। বিরোধী দল অনেকগুলো পল্গ্যাটফর্ম ব্যবহার করে সরকারের বিরোধিতা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জনসভা, মানববন্ধন, মিছিল ও হরতাল। গত কয়েক বছরে এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো আন্দোলন বিএনপির পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। সুতরাং বিএনপিকে সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর। এই সময়ে বিএনপির সরব উপস্থিতি দেখা গেছে টকশো, পত্রিকার কলাম, সামাজিক মাধ্যমে মত প্রকাশে। আর এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংসদে বিএনপি সাংসদদের বক্তব্য।

যারা প্রশ্ন করে বিএনপি জেনেশুনেও কেন জাতীয় থেকে স্থানীয় সব নির্বাচনে অংশ নেয়, তাদের কাছে আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখি, নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি আর কীইবা করতে পারত? বর্তমান সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি জিততে পারবে এই দূরাশা করে না জনগণ। কিন্তু নির্বাচনে যাওয়ার সূত্রে দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। নির্বাচনী প্রচারের সময় জনগণের সঙ্গে দলের যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। এসব উপযোগ বিবেচনা করেই বিএনপি নির্বাচনে যায়।

কেউ কেউ বলেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি এই নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নৈতিক বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে। আমি সেটা মনে করি না কোনোভাবেই। বরং এসব নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে নির্বাচনের নামে এই দেশে আসলে কী হচ্ছে।

বিএনপির চেয়ারপারসন, অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান, মহাসচিব সর্বোপরি স্থায়ী কমিটির যৌথ সিদ্ধান্তে একটি গণতান্ত্রিক দল যেভাবে পরিচালিত হয়, সেভাবেই চলে বিএনপি। দলীয় ফোরামে প্রত্যেকেই যার যার মত প্রকাশ করতে পারে, একে অন্যের সঙ্গে দ্বিমত করতে পারে এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বিতর্কও হতে পারে। তার মানে এই নয়, বিএনপির মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা বা অভ্যন্তরীণ কোন্দল আছে। অনেক সময়ই দেখা যায় দলীয় ফোরামে কোনো একক ব্যক্তির মতকে তুলে এনে বিএনপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। সেটাও নিঃসন্দেহে বিএনপিকে খাটো করার এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চেষ্টা।

ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বর্তমান সরকার উন্নয়নকে প্রধান বিজ্ঞাপন হিসেবে তুলে এনে মানুষের সামনে ক্রমাগত প্রোপাগান্ডা চালায়। কিন্তু এই দেশের একজন শিশুও এখন জানে কীভাবে বিশ্বের সবচাইতে বেশি ব্যয়ে এই দেশে অবকাঠামো নির্মাণ করে টাকা লোপাট করা হয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই দেশে দুর্নীতির অবস্থা এতটা খারাপ নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সুফল কমবেশি সব মানুষ পাচ্ছে, তাহলে সেটাকেও কি উন্নতি বলা যায়? শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, অবকাঠামো নির্মাণ মানে উন্নয়ন নয়, এই কথাগুলো খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন শ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তার লিখিত অত্যন্ত আলোচিত বই ‘ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রিডম’-এ। সুতরাং গত কয়েক বছরে যদি উন্নয়ন হয়ে থাকে সেটি হয়েছে সরকারদলীয় গুটিকতক মানুষের, আপামর জনসাধারণের নয়।

তাই বিএনপি নিয়ে অতি চিন্তিত বুদ্ধিজীবীরা যখন নানা প্রশ্ন তুলতে থাকেন, তখন তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে বিশেষ করে যখন তারা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা, মানুষের ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার পরিস্থিতি, লাগাম ছাড়া দুর্নীতি, বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ে ভুলেও কখনও কোনো প্রশ্ন তোলেন না, প্রতিবাদ করা দূরেই থাকুক।

সংসদ সদস্য; আইনজীবী ও কলাম লেখক

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com