মনির থেকে ‘গোল্ডেন মনির, সিন্দুকে তার হাজার কোটি টাকা
‘গোল্ডেন মনির’। পুরো নাম মোহাম্মদ মনির হোসেন। একসময় কাপড়ের দোকানের সেলসম্যান মনির হিসেবে যাকে চিনতো সবাই। সেই সেলসম্যানই সময়ের পরিবর্তনে হয়ে গেলেন ‘গোল্ডেন মনির’। ৯০’র দশকে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে চাকরি করা মনির এখন হাজার কোটি টাকার অধিক সম্পত্তির মালিক। মনির এসব অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন অবৈধ পথে স্বর্ণ ব্যবসা এবং জালিয়াতির মাধ্যমে ভূমি দখল করে। টাকার দাপটে সবসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালের বাইরেই থাকলেও শেষ রক্ষা হয়নি মনিরের। সে একটি রাজনৈতিক দলে অর্থ যোগানদাতা ছিলো বলে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)। টানা ১১ ঘণ্টা অভিযানের পর শনিবার (২১ শনিবার) পুলিশের এই এলিট ফোর্সের হাতে গ্রেফতার হয় গোল্ডেন মনির।
জানা যায়, ৯০ দশকে রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটে একটি কাপড়ের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন মনির হোসেন। তারপর শুরু করে ক্রোকারিজের ব্যবসা। এক পর্যায়ে স্বর্ণ চোরাচালানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে বিপুল স্বর্ণ আনতেন তিনি। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে মেরুল বাড্ডায় বিলাস বহুল ছয়তলা বাড়ি গড়ে তোলেন। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দুইশ’র বেশি প্লট এবং ৩০টির মতো ফ্লাটের কথা স্বীকার করেছেন।
কাপড়ের দোকানের সাধারণ কর্মচারী মনির থেকে গোল্ডেন মনির হয়ে ওঠার গল্প খুঁজতে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সময় লেগেছে প্রায় দেড় বছর। এ দীর্ঘ সময়ের অনুসন্ধানে তার উত্থানের চিত্র দেখে রীতিমতো অবাক হয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারাও। শুধু তাই নয়, ওয়ান ইলেভেনের সময়ও সে টাকার জোরে পার পেয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে। এমনকি দুদকও তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অথচ এই মনিরের স্থাবর-অস্থাবর অধিকাংশ সম্পত্তিই অবৈধভাবে উপার্জিত।
শনিবার (২১ নভেম্বর) র্যাব সদর দফতর, র্যাব-৩ এর একটি টিম ও র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসুর উপস্থিতিতে টানা ১১ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে তার বিলাসবহুল বাড়িতে দুটি ছয় কোটি টাকা দামের গাড়ি পাওয়া গেলেও সেসবের ছিল না কোনও বৈধ কাগজপত্র। সেইসঙ্গে ৬০০ ভরি (আট কেজি) স্বর্ণ, প্রায় ৯ লাখ টাকার ১০টি দেশের বিদেশি মুদ্রা, বাংলাদেশি নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, অবৈধ অস্ত্র, গুলি ও বিদেশি মদ জব্দ করা হয়। এসবের কোনোটিরই ছিল না অনুমোদন।
ভূমি জালিয়াতি সম্পর্কে র্যাব জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী, গণপূর্ত ও রাজউকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করে তিনি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভূমি জালিয়াতি শুরু করেন। রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকার রাজউকের ডিআইটি প্রজেক্টে প্রতারণার মাধ্যমে অনেক প্লট নিজস্ব করে নেন। এভাবে রাজউক থেকে প্লট সংক্রান্ত সরকারি নথিপত্র চুরি করে এবং অবৈধভাবে রাজউকের বিভিন্ন কর্মকর্তার দাফতরিক সিল ব্যবহার করে রাজউক পূর্বাচল, বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা এবং কেরানীগঞ্জে বিপুল সংখ্যক প্লট করেন।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘মনিরের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বেশকয়েকটি মামলা হয়। সেইসঙ্গে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকেও মামলা হয়েছিল। সেসব মামলার প্রক্রিয়া সম্পর্ক আমরা কিছু জানি না। আমরা একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়েছি। অভিযানে তার বাসায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ স্বর্ণ, অস্ত্র ও মাদকসহ দুটি বিলাসবহুল অনুমোদনহীন গাড়ি পেয়েছি। তার অটো কার সিলেকশন শোরুমেও তিনটি অনুমোদনহীন বিলাসবহুল গাড়ি পাওয়া গেছে।’
তিনি জানান, ১৯৯৩ সালের দিকে গোল্ডেন মনির গাউছিয়া মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতো। সেখানে সে ৫০ টাকা মাসিক বেতন এবং তিনবেলা খাবারের শর্তে কাজ করেছে। ওই দোকানে মনির প্রায় ৫ বছর কাজ করে। এরপর মৌচাক এলাকার একটি ক্রোকারিজ ব্যবসায়ীর সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। ওই ব্যবসার পাশাপাশি সে লাগেজ ব্যবসা শুরু করে। এই ব্যবসার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমাদানি করতো ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে। এখান থেকেই উত্থান ঘটে গোল্ডেন মনিরের। লাগেজ ব্যবসায়ের মাধ্যমে স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে তার। এরপর ২০০০ সালের দিকে নিজেই শুরু করে স্বর্ণপাচার। সিঙ্গাপুর ও ভারত রুটেই ছিল তার স্বর্ণপাচার ও হুন্ডির ব্যবসা। আর এ ব্যবসায় থেকে অর্জিত টাকা দিয়ে গোল্ডেন মনির রাজউক ও গণপূর্তের অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ভুয়া সিল-স্বাক্ষরের মাধ্যমে একাধিক ভূমি দখল করে।
এলিট ফোর্সের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘রাজধানীর বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে তার দুই শতাধিক প্লট রয়েছে। সেইসঙ্গে বর্তমানে তার এক হাজার ৫০ কোটির অধিক অর্থের হিসাব পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার দীর্ঘ অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে আসে।’
আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘গ্রেফতার মনিরের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করবে র্যাব। মনিরের নামে দুইটি মামলা চলমান রয়েছে। রাজউকের সিল নকল করে ভূমিদস্যুতা ও দুদকের করা একটি মামলা চলমান রয়েছে।’
এদিকে ‘দেশত্যাগের চেষ্টার অভিযোগ সত্য নয়’ দাবি করে গোল্ডেন মনিরের বড় ছেলে মোহাম্মদ রাফি হোসেন বলেন, ‘আমার বাবা প্রায় সময়ই দুবাইয়ে চিকিৎসা করাতে যান। রবিবারও চিকিৎসার জন্য যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু তিনি কোন রোগের চিকিৎসার জন্য দুবাই যাবেন সেটি বলতে পারি না।’
তার বাবা নির্দোষ এবং স্বনামধন্য একজন ব্যবসায়ী উল্লেখ করে রাফি বলেন, ‘আমার বাবা নির্দোষ। তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন না। আমরা আইনগতভাবে সব মোকাবিলা করব। বাবার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে সব ভিত্তিহীন। তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। আমরা কোর্টে যাব। সেখানেই প্রমাণ হবে বাবা দোষী কি-না। সম্পূর্ণ ভুল বোঝাবুঝির কারণেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
তবে র্যাব বলছে, গোল্ডেন মনিরের বড় ধরনের কোনো রোগ আছে বলে র্যাব এখনও জানতে পারেনি। এমনকি প্রাথমিকভাবে তারা নিশ্চিতও হয়েছেন যে, রোগের জন্য বিদেশে গিয়ে তার চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন নেই।
এদিকে, গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে র্যাব বাদী হয়ে তিনটি মামলা করেছে বাড্ডা থানায়। এর মধ্যে একটি মামলা বিশেষ ক্ষমতা আইনে। বাকি দুটি হয়েছে অস্ত্র ও মাদক আইনে। এই তিন মামলায় মনিরের ২১ দিনের রিমান্ড চাইবে পুলিশ।
রবিবার (২২ নভেম্বর) সকালে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, শনিবার রাতে র্যাব-৩ বাদী হয়ে অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনটি মামলা করে। মামলায় আজ দুপুরে মনিরকে সিএমএম আদালতে নেয়া হবে। আদালতে নিয়ে তাকে প্রতিটি মামলায় ৭ দিন করে মোট ২১ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে।