সব সূচকেই করোনা বেড়েছে
দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার বাড়ছে। একজন থেকে একাধিক জনের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার আর-নট রেটও (ভাইরাসের রিপ্রোডাকশন রেট) বেড়েছে। এমনকি করোনায় বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। অথচ সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগে চরম শৈথিল্য চলছে। এসব কর্মকা-ের কাক্সিক্ষত মাত্রায় অগ্রগতি নেই। বিশেষ করে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে তীব্র অনীহা দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ সরকারের নেওয়া ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ কর্মসূচি মাঠপর্যায়ে তেমন কোনো বাস্তবায়ন নেই।
এমন পরিস্থিতিতে ‘বিপজ্জনক’ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তারা এখনই এ বাড়াকে অতটা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন না। এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, গত তিন দিনের গড় করলে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই বেড়েছে। তবে এ হার যদি দেড়গুণ হয়, অর্থাৎ কিছুদিন আগে সংক্রমণের হার ছিল ১০-১২ শতাংশ, সেটা যদি ১৫ শতাংশের বেশি হয় এবং অন্ততপক্ষে চার সপ্তাহ একই থাকে বা বাড়ে, তাহলে আমরা বলতে পারব তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে, দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। তা না হলে সে পরিস্থিতিকে বলা হবে সংক্রমণ হার ওঠানামা করছে। তখন এটা কমেও যেতে পারে। তাই এই মুহূর্তে বলা যাবে না তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে। এ বাড়াটা সাময়িকও হতে পারে। আমাদের আগামী সপ্তাহটা দেখতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য এবং বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহ ধরেই দেশে করোনার সংক্রমণ ও করোনায় মৃত্যু বাড়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে দুই মাসের মধ্যে (৫৭ দিন) গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত রবি ও সোমবার ২১ জন করে রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। এর আগে সর্বশেষ গত ২১ সেপ্টেম্বর ২৪ ঘণ্টায় ৪০ রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। তারপর গতকালেরটাই সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা।
পাশাপাশি গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আড়াই মাসের (৭৬ দিন) মধ্যে এবং পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার ৭১ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে। ৭০ দিন পর গত সোমবার দুই হাজারের বেশি রোগী শনাক্তের পর গতকাল মঙ্গলবার তার চেয়েও বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২ হাজার ২১২ জন করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে, যা গত ৭৬ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ গত ২ সেপ্টেম্বর এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল। গতকাল প্রায় ১৬ হাজার নমুনা পরীক্ষায় ১৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ হারে রোগী শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের এ হারও গত ৭১ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকেই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। মে, জুন ও জুলাই মাসে প্রতিদিন চার হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত এবং ৩০-৪০ জনের মৃত্যুর ঘটনা দেখা যায়। পরে অবশ্য তা কমে আসে। এমন অবস্থায় শীতের সময়ে করোনাভাইরাসের আরেক দফা সংক্রমণ দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করে দেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম বাংলাদেশে শীতকালে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথা বলেন। এরপর তিনি শীতে রোগটি প্রতিরোধে নানা উদ্যোগ নিতে তাগিদ দেন স্বাস্থ্য বিভাগকে। সে অনুযায়ী সর্বশেষ সরকার স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর সর্বোচ্চ জোর দেয় এবং মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এমনকি গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে এবার রাজধানী ঢাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানোর কথা জানানো হয়।
করোনা সংক্রমণ বাড়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা রোগটি নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের শৈথিল্যকে কারণ হিসেবে দেখছেন। বিশেষ করে দুই মাসেরও বেশি সময়ে সরকার মাস্ক পরতে নানা ধরনের নির্দেশনা জারি করলেও এখনো মাস্কের ব্যাপারে ভীষণ অনীহা মানুষের। রাজধানীতে খুব অল্পসংখ্যক মানুষকেই মাস্ক পরতে দেখা যায়। রাজধানীর বাইরে মাস্ক পরার হার ১০ শতাংশেরও কম বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনরা। তারা জানান, সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিভিন্ন সরকারি অফিসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি ব্যানার টানানো হয়েছে। কিন্তু মাস্ক পরার হার খুবই কম।
করোনার বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সরকারের করোনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং প্রবীণ ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়তির দিকে, মৃত্যুও বেড়েছে। এ পরিস্থিতি আরও সপ্তাহখানেক দেখতে হবে। যদি ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে তাহলে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ হতে পারে। তবে এখনই কিছু বলা যাবে না। করোনার প্রকৃত চিত্র বুঝতে যতগুলো নমুনা পরীক্ষা করা দরকার, ততগুলো হচ্ছে না। যা পাচ্ছি, তা থেকেই একটা ধারণা নিতে হবে। সুতরাং দেখা যাক কী অবস্থা হয়। এখনো অ্যালার্মিং বা উদ্বেগজনক বলা যাবে না। সংক্রমণের হার বাড়ার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। দেখা যাক এটা কোথায় গিয়ে ঠেকে।
এ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে বলেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এখনো আমাদের স্বাস্থ্যবিধির দিকেই মনোযোগ দিতে হবে। প্রথম থেকেই আমরা চেষ্টা করছি সবাই যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। কিন্তু সেটার প্রবণতা কম। সরকার ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নামে একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সেটা মানতে দেখা যাচ্ছে না। দোকান মালিক সমিতি বলেছিল, দোকানে বিক্রেতা-ক্রেতা উভয়ই মাস্ক না পরলে কোনো পণ্য বেচাকেনা হবে না। কিন্তু দোকান মালিক সমিতির কাজে সেটা রূপান্তরিত হয়নি। তার মানে সরকারি প্রজ্ঞাপন বা নির্দেশ মানা হচ্ছে না। এ নিয়ে খবরদারি হচ্ছে বলেও দেখা যাচ্ছে না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের কথা ভাবছে সরকার। এটা ভালো হবে। কারণ করোনা নিয়ন্ত্রণে মূল বিষয় স্বাস্থ্যবিধি। সেটা যে করেই হোক সবাইকে মানতে হবে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে বলে জানান। তিনি বলেন, করোনায় মৃত্যু বেড়েছে। তবে বড় আশঙ্কা আক্রান্তের সংখ্যা ও পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার বেড়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের হার ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত তিন দিন ধরেই ১৩ শতাংশের ওপরে দেখা যাচ্ছে। এটা ১০-১১ শতাংশের মধ্যে অনেক দিন ছিল। এখন আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। নমুনাও বেশি প্রায় ১৬ হাজার পরীক্ষা করা হয়েছে। সাধারণত নমুনা বেশি হলে সংক্রমণের হার কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু সংক্রমণ হার বেড়েছে। তার মানে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
এ বাড়াটা কী কারণে হতে পারে জানতে চাইলে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এমন হতে পারে শীত চলে আসছে। আমরা কেউ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি না সেটাও একটা কারণ। এ কর্মকর্তা দেশে করোনার সংক্রমণ হার আর-নট রেট (ভাইরাসের রিপ্রোডাকশন রেট) বেড়ে গেছে বলেও জানান। তিনি জানান, বর্তমানে আর-নট রেট ১-এর ওপরে আছে। অথচ এটা ১-এর নিচে দশমিক ৮-এর মতো ছিল। তখন একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে একজনের কমসংখ্যক মানুষকে সংক্রমিত করত। পাঁচজন থেকে তিনজনে ছড়াত। কিন্তু আর-নট রেট আবার বেড়ে ১-এর ওপরে চলে গেছে। এর অর্থ এখন একজন থেকে একজনে ছড়াচ্ছে। দুই মানে দুজন থেকে দুজনে ছড়ায়, এই দুজন আবার চারজনে ছড়ায়। সারা পৃথিবীতে এ ভাইরাসের আর-নট ছিল ২ থেকে ৩ পয়েন্ট ৮, একজন থেকে চারজন পর্যন্ত ছড়িয়েছে। পৃথিবীর সব দেশে সংক্রমণ যখন অনেক ওপরে থাকে তখন লক্ষ্য থাকে আর-নট প্রথমে ২-এ আনতে হবে। ২-এর পর লক্ষ্য থাকে ১-এ আনতে হবে। আর-নট-১ হলেও মহামারী। একের নিচে যখন নামে তখন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার একটা সম্ভাবনা থাকে।
এমন অবস্থায় সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে বলে পরামর্শ দেন এ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে যাদের বয়স পঞ্চাশের ওপরে তাদের করোনা পজিটিভ হলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে যদি কেউ হাসপাতালে না যায়, সময়মতো চিকিৎসা না নেয়, একেবারে শেষ মুহূর্তে আসে, তখন চিকিৎসা জটিল হয়ে যায়। গত কয়েক দিন ধরে যারা মারা যাচ্ছে, বিশেষ করে গত ২৪ ঘণ্টায় যে ৩৯ জন মারা গেছে, তাদের মধ্যে ৩৪ জন ৫০-৬০ ঊর্ধ্ব বয়স। যাদের বয়স পঞ্চাশের ওপর, যাদের মরবিডিটি আছে, তারা যদি করোনা পজিটিভ হয়, তারা যেন খুব দ্রুত যেকোনো হাসপাতালে চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা নেয়। বাসায় থাকলে জটিল আকার ধারণ করতে পারে। দ্রুত হাসপাতালে এলে আইসিইউ বা ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হয় না। জীবন বাঁচানো খুব সহজ। এ কথাগুলো সবাইকে বলতে হবে।
করোনার বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহের সংক্রমণ বাড়ল কি না, তাহলে বোঝা যাবে একজনের থেকে একাধিক লোকে ছড়াচ্ছে। গত কয়েক দিন ধরেই সংক্রমণ একটু বেশি। মৃত্যুর সংখ্যাটা ওঠানামা করছে। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। গতিবিধির দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
তিনি বলেন, যারা শনাক্ত হচ্ছে, তাদের আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন করা, স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য মানুষকে সহায়তা করা এবং আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনকে সহযোগিতামূলক করতে হবে। কারণ আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনের ভয়ে মানুষ পরীক্ষা করতে আসছে না। কেননা তাদের রুটি-রোজগারে টান পড়বে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়। এসব মানুষ যদি মৃদু লক্ষণযুক্ত থাকে, তারা প্যারাসিটামল খেয়ে থাকে। কিন্তু তারা রোগ ছড়াচ্ছে। এভাবেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এর অর্থই হলো করোনার পরিণতি খারাপের দিকে যাওয়া।