সহশিল্পীদের চোখে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
অস্কারজয়ী বাঙালি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে বেশি সিনেমার নায়ক তিনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তার অভিনয়, ব্যক্তিত্ব আর বাচনভঙ্গির ভক্ত। এ প্রজন্মের কাছে ‘বেলাশেষে’র ঘরের মানুষ তিনি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোকে ভেঙে পড়েছে বাংলা সিনেমার দর্শক। এই কিংবদন্তি অভিনেতার সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছেন আমাদের শোবিজের চার উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাকে স্মরণ করেছেন ববিতা, চম্পা, ফেরদৌস, ঈশিতাসহ কলকাতার জনপ্রিয় নায়িকা ঋতুপর্ণা।
অমন ভদ্র সহশিল্পী আর দেখিনি
ববিতা
আমার সৌভাগ্য যে বাংলাদেশের একমাত্র শিল্পী হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা হয়েছি। সেই সঙ্গে আমিই একমাত্র নায়িকা যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো কিংবদন্তির নায়িকা হয়েছি। ‘অশনি সংকেত’ আমার জীবনে সব সময় অন্যরকম সুখস্মৃতি। এমন কোনো বিষয় নেই যার জন্য এ সিনেমাকে আমি নেতিবাচকভাবে মনে রাখতে পারি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সিনেমার নায়ক, তিনি ততদিনে ফেলুদা করে সবার নয়নের মণি। আমি সেই মানুষটির সঙ্গে কাজ করছি, সেটা আমার জন্য ছিল স্বপ্নের চেয়ে বেশি কিছু। প্রথম যেদিন দেখলাম, আমি অনেকটা হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। সুদীর্ঘ শরীরের ফর্সা একটি স্লিম শেপের মানুষ। কিন্তু আওয়াজ খুব ভারী, মিষ্টি হাসি। হাসি ছাড়া কথা বলতেন না। ক্যামেরার বাইরের এই অতি সুদর্শন মানুষটি যখন ক্যামেরার সামনে হতদরিদ্র ব্রাহ্মণ হয়ে উঠতেন তখন মাঝেমধ্যে তাকে অচেনা লাগত। তাকে দেখে শিখেছি কীভাবে চরিত্রের মধ্যে আত্মনিবেদন করতে হয়। আমাকে বলতেন, আমি খুব ন্যাচারাল অ্যাক্টর। তার মতো অমন ভদ্র সহশিল্পী আমি আর দেখিনি। আমি জানি অমন ভালো মানুষ যেখানেই থাকেন না কেন, ভালো থাকবেন।
সুপারস্টারের চেয়ে বড় কিছু থাকলে তিনি তাই
চম্পা
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় বড় বোনের (ববিতা) সূত্র ধরেই। তিনি ববিতা আপার নায়ক ছিলেন ‘অশনি সংকেত’-এ। কোনোদিন ভাবিনি তার সঙ্গে আমিও অভিনয় করব। সেই সুযোগটি করে দিয়েছিলেন গৌতম ঘোষ। তার ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে আমরা কাজ করেছিলাম। আরও ছিলেন রূপা গাঙ্গুুলি, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, বলিউড তারকা শর্মিলা ঠাকুর, টাবুর মতো শিল্পীরা। এ সিনেমা আমার জীবনে অন্যতম অর্জন। আমি খুব ভাগ্যবান, এত বড় শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এখনো মনে পড়ে , আমরা জলপাইগুড়ির একটি চা বাগানে কাজ করেছিলাম লম্বা সময় ধরে। শ্যুটিং শেষে অনেক গল্প-আড্ডা হতো। তখন তিনি আমাদের তার সিনেমার অভিজ্ঞতার কথা শুনাতেন। মাঝেমধ্যে শর্মিলা ঠাকুর তাকে অপুর সংসারের কথা মনে করিয়ে দিতেন। ববিতা আপার কথাও জিজ্ঞেস করতেন। ‘অশনি সংকেত’র স্মৃতি শেয়ার করতেন। আমি আর টাবু হা করে সেই গল্পগুলো গিলতাম। তার কাছ থেকে কত কী যে শিখেছি। সুপারস্টারের চেয়ে বড় যদি কিছু থেকে থাকে তিনি তাই। কিন্তু কোনো অহংকার, শো অফ করতে দেখিনি। সময়ের ব্যাপারে ছিলেন খুবই পাংচুয়াল। শট শেষে উঠে চলে যেতেন না, সহশিল্পী কেমন কাজ করছে দেখতেন। একবার আমার একটা গানের শট শেষ হতেই তিনি বাহবা দিয়ে উঠলেন। বললেন, ‘এত চমৎকার করে তুমি গানটায় লিপ সিং করলে, মনে হলো নিজেই গাইছ।’ তখন মনে হয়েছিল, অভিনয় কিছুটা হলেও শিখেছি।
আমাদের অন্যরকম বন্ধুত্ব ছিল
ফেরদৌস
আমার দ্বিতীয় সিনেমা ‘চুপি চুপি’তেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সহশিল্পী হিসেবে পাই। এরপর ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’, ‘চুড়িওয়ালা’সহ ছয় থেকে সাতটি সিনেমা করেছি। প্রথম যেদিন দেখা হয়, সেদিনই তাকে বলেছিলাম, ‘তুমি তো আমার ফেলুদা’। তিনি সহাস্যে বলেছিলেন, ‘তুমি ফেলুদা পড়েছ!’। আমি তাকে জানাই, আমি ফেলুদা সিরিজ এবং তোমার অনেক বড় ভক্ত। কাকতালীয় বিষয় হলো, তিনি রাজস্থানের যে জায়গায় ‘সোনার কেল্লা’র শ্যুটিং করেছিলেন, বহু বছর পর আমার ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমার শ্যুটিং সেখানেই হয়। এখন পর্যন্ত মাত্র এই দুটি বাংলা সিনেমার শ্যুটিংই হয়েছে সেখানে। জায়গাটা ‘সোনার কেল্লা’ নামেই পরিচিতি পেয়েছে সিনেমার জনপ্রিয়তার জন্য। এ কথা জানার পর থেকেই আমাদের অন্যরকম বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ‘চুপিচুপি’র প্রথম দিনের শ্যুটিংয়ে তার ডায়ালগ ছিল পুরো এক পৃষ্ঠা। একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা তার মেয়ের প্রেমিককে (ফেরদৌসকে) কথাগুলো বলছেন। তিনি ৫-৭ মিনিটের মতো স্ক্রিপ্টটা দেখলেন এবং শটে চলে গেলেন। সেটের সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখলাম ‘নির্ভুলভাবে সব সংলাপের সঙ্গে এক টেকে কী দারুণ অভিনয় করলেন!’ জানি না অভিনয় কতটা পারি, রাষ্ট্র আমাকে পাঁচবার জাতীয় পুরস্কার দিয়েছে। যা শিখেছি বাসু চ্যাটার্জি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জিত মল্লিক, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, কিংবা আমাদের দেশের রাজ্জাক, আলমগীর সাহেবদের মতো কিংবদন্তিদের কাছ থেকেই। আমি ধন্য এত বড় অভিনেতাদের সাহচর্যে আসতে পেরেছি।
তিনি অভিনয়ের ইনস্টিটিউশন
ঋতুপর্ণা
আমার প্রথম সিনেমা ‘শ্বেত পাথরের থালা’র সহশিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর কত সিনেমা করেছি তা গুনে শেষ করা যাবে না। তিনি একজন অভিনয়ের ইনস্টিটিউশন। একই সঙ্গে সফল মানুষ। তার কাছ থেকে শিখেছি অভিনয়জীবন ও পারিবারিক জীবন কীভাবে আলাদা রাখতে হয়। আরও শিখেছি কাজকে কতটা ভালোবাসলে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ক্যামেরা অ্যাকশনের মধ্যেই কাটিয়ে দেওয়া যায। ভক্তদের টানে গ্রামগঞ্জে গিয়ে শো করা যায়। আমি তার পথ অনুসরণ করি।
তার নাম শুনেই রাজি হয়ে যাই
ঈশিতা
২০১৮ সালের শুরুর দিকে ‘কাঠপেন্সিল’ নামের একটি টেলিছবিতে আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করেছিলাম। তার আগে টানা ৫ বছর অভিনয় করিনি। ভেবেছিলাম কাজ শুরু করব, কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় না থাকলে হয়তো অত দ্রুত ফেরা হতো না। এখন মনে হয়, সেই সিদ্ধান্তটা আমার জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি। আমাদের শ্যুটিং হয়েছিল কলকাতায়। তার বয়স তখন ৮৩ বছর। সেই বয়সেও তার সময়-নিয়মানুবর্তিতা, পেশাদারিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। শুধু সেটে আসাই নয়, আসার আগে তিনি আরও প্রস্তুতি নিয়ে আসতেন। একবারও দেখিনি তার একটা সংলাপ ভুল হয়েছে। আমরা তখনো জানতাম না তিনি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছেন। কারণ তার কাজে সেই ছাপ পাওয়া যায়নি। এত বড়মাপের অভিনেতা কিন্তু কখনোই ডিরেক্টরের কথার বাইরে কিছু করতেন না। প্রতিটি শট দেওয়ার পরই আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, কোনো কিছু মিস হলো কি না? পরিচালককে বলতেন, আবার শট দিতে হবে কি না! সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একটা প্রতিষ্ঠান। তিনি আমার দাদি, আমার মা, আমার এবং আমার সন্তানের প্রিয় অভিনেতা। এ বিষয়টিই বলে দেয় তার সফলতা কতখানি।