বরিশালে ফের সক্রিয় ‘আব্বা গ্রুপ’

0

পুলিশি অভিযানের মুখে বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর আবারও সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু করেছে বরিশালের কুখ্যাত কিশোর গ্যাং ‘আব্বা গ্রুপ’। গত বছরের আগস্টে নগরীর সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুজিত কুমার দেবনাথকে কুপিয়ে আহত করার পর আত্মগোপনে যায় এ গ্রুপের সদস্যরা। প্রায় ১৪ মাস পর গত সপ্তাহে সরকারি বরিশাল কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম টিপুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করার মধ্য দিয়ে আবারও প্রকাশ্যে আসে গ্রুপটি। ৭ নভেম্বরের ওই ঘটনায় গুরুতর আহত টিপু এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ঢাকায় তার চিকিৎসা চলছে।

এ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়স ১৬ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। তানজিম রাব্বি ও সৌরভ বালার নেতৃত্বে ৪০-৫০ জনের মূল গ্রুপটিই এখন আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ গ্রুপে রয়েছে ১০টি উপ-গ্রুপ। এসব উপগ্রুপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয় নগরীর বিভিন্ন এলাকা। মূল গ্রুপ এবং উপগ্রুপ মিলিয়ে ‘আব্বা গ্রুপ’র সদস্য সংখ্যা ১শ’র বেশি। এখন পর্যন্ত তাদের কাছে কোনো রকম আগ্নেয়াস্ত্র থাকার খবর না মিললেও বিভিন্ন সময়ে হামলার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে দেখা গেছে দেশীয় নানা ধারালো অস্ত্র। ৭ নভেম্বর শনিবার রাতে ছাত্রদল নেতা টিপুর ওপর হামলার সময় ব্যবহার করা হয় চাইনিজ কুড়াল, বগি দা, চাপাতিসহ ধারালো সরঞ্জাম। হামলার পর টিপুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ‘হত্যার উদ্দেশ্যেই টিপুর ওপর হামলা চালায় কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীরা। তবে চিৎকার শুনে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এলে তারা পালিয়ে যায়।’ আহত টিপুকে হাসপাতালে নেয়ার সময় সে নিজেই হামলাকারী হিসেবে ‘আব্বা গ্রুপ’র সদস্যদের কথা জানিয়েছেন উপস্থিত সবাইকে।

অনেক আগে থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে এলেও কিশোর গ্যাং ‘আব্বা গ্রুপ’ প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল। নগরীর জিলা স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে একটি বিরোধের জেরে ওইদিন সন্ধ্যায় আব্বা গ্রুপের প্রায় ২০ সদস্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নামে। জিলা স্কুলের মোড় থেকে ব্রাউন কম্পাউন্ড পর্যন্ত সড়কে বহু গাড়ি ভাংচুর ও কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালায় তারা। এ সময় এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে জখম করা হয়। ওই ঘটনায় স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ সৌরভ বালাকে ধারালো অস্ত্রসহ আটক করে। ওই সময় স্কুলছাত্র সাগর হাওলাদার, রিফাতুল ইসলামসহ আরও ৭-৮ জনকে আটক করে পুলিশ। আটক সবাই নগরীর বিএম স্কুল, মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একে ইন্সটিটিউটের ছাত্র ছিল। কিছুদিন পর জেল থেকে বের হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে গ্রুপের সদস্যরা। চাঁদা না পেয়ে ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর নগরীর গির্জা মহল্লায় একটি মোবাইলের ফোনের দোকান ভাংচুর এবং দোকান মালিক সোহেল ও জুয়েলকে বেধড়ক পেটায় এ গ্রুপের সদস্যরা। ওই ঘটনায় ৭ জনকে আসামি করে থানায় মামলাও হয়। এরপর থেকে নগরীর সদর রোড, ফকির বাড়ি রোড, কাঠপট্টি, কালীবাড়ি রোড, গির্জা মহল্লা, পাসপোর্ট গলি, নিউ সার্কুলার রোড, বটতলা, বগুড়া রোডসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে চলতে থাকে তাদের বেপরোয়া চাঁদাবাজি। এছাড়া নগরীর গার্লস স্কুলগুলো ছাড়াও বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের সামনে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ছিল তাদের রুটিন কাজ। বর্তমানে গ্রুপটির সদস্যরা ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। টাকার বিনিময়ে যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে তারা। গ্রুপের অন্যতম নেতা তানজিম রাব্বি কয়েক বছর আগে ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চে এক নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিল। এরপর কলেজকেন্দ্রিক নানা অপকর্মের কারণে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে পুলিশের হাতে আবারও ধরা পড়ে গ্রুপের অন্যতম লিডার সৌরভ বালা। অবশ্য প্রতিবারই জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।

বরিশাল সিটি কলেজের ক্যাশিয়ার এসএম সাইদুর রহমান জানান, ‘২০১৫ সালে কলেজের অফিস কক্ষের আলমারি ভেঙে টাকা লুট করেছিল এ গ্রুপ। ২৯ জুলাই ওই মামলায় সাক্ষ্য দিয়ে ফেরার পর সৌরভ বালা ও তার সহযোগীরা ক্যাম্পাসে ঢুকে হট্টগোল করে। খবর পেয়ে পুলিশ সৌরভ বালা ও ইয়ামিন হোসেন জুয়েলসহ তিন যুবককে আটক করে। কলেজ কর্তৃপক্ষ হট্টগোলের ওই ঘটনায় মামলা না করায় পুলিশ তাদের মেট্রো অধ্যাদেশে আদালতে পাঠায়। ৩১ জুলাই আদালত থেকে ছাড়া পেয়েই দলবল নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে সৌরভ, রুবেল ও ইয়ামিনরা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুজিত কুমার দেবনাথকে কুপিয়ে জখম করে। ওইদিন কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলার পর রুবেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে সময় থানার ওসি নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘হামলাকারী বাকি আসামিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’ তবে পুলিশ ওই গ্রুপের আর কাউকে গ্রেফতারে সক্ষম হয়নি। এ ঘটনার পর টানা ১৪ মাস আত্মগোপনে ছিল গ্রুপটি। ৭ নভেম্বর রাতে নগরীর কালীবাড়ি রোডের একটি খাবার হোটেলে ঢুকে রফিকুল ইসলাম টিপুকে কুপিয়ে আহত এবং হোটেল ভাংচুরের মাধ্যমে আবারও প্রকাশ্যে আসে গ্রুপটি। সশস্ত্র ওই হামলায় আব্বা গ্রুপের লিডার তানজিম রাব্বি, সৌরভ বালা, রাজিন, সাগরসহ ৪০-৫০ জন অংশগ্রহণ করে বলে জানিয়েছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী। মাদক ব্যবসায় বাধা এবং সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে এ হামলা হয় বলে দাবি তার। বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি নুরুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। আহতকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় থাকায় মামলা করতে বিলম্ব হলেও হামলাকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সাহিত্যিক ও গবেষক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, ‘বরিশালে একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে এ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এদের কোনো দল নেই। যখন যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের হয়ে যায়। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘অপরাধ করলে বড় হোক বা ছোট হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা অপরাধ দমনে কাজ করছি এবং কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে সচেতনও করছি।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com