জিয়া, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে

0

এই জাতীর জীবনে যদি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর না আসতো, তাহলে কী হতো? কী হতো যদি ৩ নভেম্বরের পর থেকে কার্যত কোনো সরকার না থাকা বাংলাদেশ আরো বেশ কিছুদিন‌ সেভাবে চলতো? কোন‌ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের হুমকি তৈরি হলে চেইন অব কমান্ড পুরোপুরি ভেঙে পড়া ‌একটা সেনাবাহিনী কী করত তখন? কিংবা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্ৰুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে সেটা দেশকে কোন পরিস্থিতিতে নিয়ে যেত?
১৯৭৫ এর ৪৫ বছর পর এই ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে এই নভেম্বর মাসে দেখি – ভাগ্যিস একজন জিয়াউর রহমান সেদিন এই জাতির ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল, এবং ধীরে ধীরে সেটা যতটা খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছিল সেটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকেই ভীষণ বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে দিয়েছিল। সেই বিপদ থেকে এই রাষ্ট্র ৭ নভেম্বর বেরিয়ে এসেছিল এত অসাধারণভাবে যার চাইতে ভালো কিছু আর হতে পারত না। 

নভেম্বর মাসের শুরুতে অবিশ্বাস্য যেসব ঘটনা ঘটেছিল এবং সেগুলোর পরম্পরায় একটা পর্যায়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কীভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন সেই ঘটনাপ্রবাহ কমবেশি আমরা সবাই জানি। সেই সব ঘটনার পুনরুল্লেখ করছি না। কিন্তু ৭ ই নভেম্বর শহীদ জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসা বিশ্বের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। 
পৃথিবীর নানা দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। হয়েছে এই দেশেও। এমনকি ৭ ই নভেম্বরের আগেই খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর একটা সামরিক অভ্যুত্থান করেছিলেন, যেটা ব্যর্থ হয়। ‌ ৭ ই নভেম্বরে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল সেটা ছিল সিপাহী-জনতার মিলিত অভ্যুত্থান। এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা; এটাই এই অভ্যুত্থানটিকে আলাদা করে আর সবগুলো থেকে। ওই দিনটিতেই সামরিক-বেসামরিক মানুষ ফিরে গেল সেই মানুষটার কাছে যে মানুষটা সাড়ে চার বছর আগে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়া একটি জাতিকে পথ দেখিয়েছিলেন। 
২৫ শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর  কর্যাকডাউন ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর পর পুরো জাতি হয়ে পড়ে রক্তাক্ত, ভীত, দিকনির্দেশনাহীন। সেই অবস্থায় এই জাতিকে যে মানুষটা স্বাধীনতা ঘোষণা করে মানুষের মনে আস্থা, সাহস এবং অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন, সেই মানুষটাকেই আবার এই দেশের ক্রান্তিলগ্নে মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতার ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। জনগণের মনে একজন মেজর জিয়ার প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস কতটা গভীর ছিল ৭ নভেম্বর আবার সেটা প্রমাণিত হয়েছিল। তাদের এই আস্থা যে কতটা সঠিক ছিল সেটা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিদিন প্রমাণ করে গিয়েছেন শহীদ জিয়া।

৭ নভেম্বরের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটা জিয়ার সামনে ছিল সেটা হচ্ছে সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা। একটা সশস্ত্র বাহিনীতে যখন চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় যেটা দেশকে একেবারে গৃহযুদ্ধের মুখে মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। বাংলাদেশ ছিল সেই পরিস্থিতিতেই। সেই সময় অত্যন্ত শক্ত হাতে তিনি সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সেই সময় তার নেয়া পদক্ষেপ গুলোকে যারা সমালোচনা করেন, তারা হয় সে সময়কার বাস্তবতা জানেন না, কিংবা মতলববাজি করে জেনেশুনে অস্বীকার করেন। 
সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার সফলতা দিয়ে শুরু। এরপর একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে জিয়া ক্রমাগত ছাড়িয়ে যেতে থাকেন নিজেকে। স্বাধীনতার পর পর সমাজতন্ত্রের নামে একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নেয়া হতে থাকে। এর মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল বেসরকারি খাতকে অগ্রাহ্য করে সবকিছু সরকারি মালিকানায় রাখার চেষ্টা। এতে দেশের শিল্প-ব্যবসার বড় অংশ অত্যন্ত অদক্ষ এবং দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। এর সাথেই সমাজতন্ত্রের ধুয়ো তুলে এই রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত ছিল বাকশাল গঠন করা। মুখে সমাজতান্ত্রিক মডেলের কথা বলাটা ছিল আসলে একটা বাহানা, এর মাধ্যমে এক ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত ‌ করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। 

মজার ব্যাপার আওয়ামী লীগ বাকশালের পক্ষে নানা রকম যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলেও ২০০৯ সাল থেকে দুই-তৃতীয়াংশ এবং পরে তার চাইতেও বহু বেশি আসন নিয়ে সংসদে থাকলেও চতুর্থ সংশোধনীর মত আর কোন সংশোধনী আনার সাহস করেনি। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ দলটি আবার নতুন জীবন পেয়েছিল জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই। রাষ্ট্রকে আবার বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাগুলোর একটা। বিভাজিত জাতিকে এক্যবদ্ধ করতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের যে আদর্শ তিনি স্থাপন করেন সেটি বাংলাদেশ যতদিন থাকবে মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় জিয়াকে অমর করে রাখবে।
শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক সংস্কারের সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল বেসরকারি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে একটি পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা। বেসরকারি খাত উন্নয়নে নানা রকম নীতি সাহায্য নিশ্চিত করেছিলেন। মজার ব্যাপার বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটি পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানে সমাজতন্ত্র যুক্ত করলেও চালু রেখেছে শহীদ জিয়া প্রবর্তিত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই।

এই রাষ্ট্রের আর্থিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। নিকট অতীতে বাংলাদেশের সবগুলো সরকার যে তিনটি সেক্টরের উপরে ভিত্তি করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে উন্নতি নিয়ে গর্ব করেছে তার মধ্যে দু’টির (গার্মেন্ট, প্রবাসী কর্মী) একেবারে গোড়াপত্তন হয়েছে শহীদ জিয়ার হাত ধরে আর অপরটির (কৃষি) ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে তাঁর নেয়া নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে।
এই দেশে গার্মেন্ট শিল্প আজ দেশের প্রধান রপ্তানি খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয় এই খাতে প্রায় অর্ধকোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয় এই সেক্টরে। এই পরিমাণ মানুষের সামষ্টিক ভোগের পরিমাণ বিপুল, তাদের উপর ভিত্তি করে আরো নতুন নতুন শিল্প-ব্যবসা তৈরি হয়েছে। তাই দেশের জিডিপিতে এর অবদান অনেক বড়।
এই দেশের এক কোটির বেশি মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকে, যার প্রধান অংশটি থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। মূলত এই মানুষগুলোর পাঠানো রেমিট্যান্স‌ই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যুক্ত হওয়া ২২  লক্ষ মানুষ কী করতো, কেউ কি একবারও ভেবে দেখছি? বিদেশে কর্মী এভাবে না যেতে পারলে তার ফলশ্রুতিতে তৈরি হওয়া বেকার সমস্যা এই দেশের সামাজিক অস্থিরতা কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতো অনুভব করা আমরা? এই দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভর করে আছে রেমিটেন্স এর ওপারে। কতটা ভবিষ্যতদ্রষ্টা হলে একজন মানুষ আজ থেকে চার দশকেরও বেশি সময় আগে এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন এবং কর্মীদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো শুরু করেন। 
এখনকার বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ দিতে দিতে আমাদের পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নেমে যাচ্ছে। এটা এক ভয়ংকর পরিস্থিতি। তাই বেশ কিছুদিন থেকে সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। ‌শহীদ জিয়া তাঁর সময়ে এই ভূপরিস্থ পানি ব্যবহারের জন্য খাল কাটা কর্মসূচি সারা দেশে চালু করেছিলেন। 
জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই দেশের বিরাট সমস্যা হয়ে উঠতে পারে সেটা জেনেই পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চালু করেন তিনি। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে খাদ্য মজুদের জন্য বড় বড় গুদাম তৈরি করা হয় তার সময়ে। শিক্ষাকে সব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, গণশিক্ষা এবং বয়স্ক শিক্ষা চালু করেন তিনি।  রাষ্ট্রের সাথে পল্লীর জনগণের সম্পর্ক তৈরি করার জন্য গ্রাম সরকার, আনসার-ভিডিপি তাঁরই অবদান। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নাগরিকদের উৎসাহ প্রদান করার কথাও ভুলে যাননি তিনি – চালু করেছিলেন একুশে এবং স্বাধীনতা পদক।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এর যে মিথ্যে প্রপাগ্যান্ডা চালানো হয়, সেটা আসলেই ছিল তাঁর সময়ে। নিজে ছিলেন যে কোনও রকম দুর্নীতি থেকে একেবারেই মুক্ত শুদ্ধতম মানুষ আর লড়াই করে যাচ্ছিলেন সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করার। সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রম, নিরপেক্ষতা, দূরদর্শীতা, কঠোর পরিশ্রম তাকে একেবারে আলাদা করেছিল আর সব রাজনীতিবিদের থেকে।
একথা বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হয় না বর্তমানে যে বাংলাদেশে আমরা দেখছি তার মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার হাত ধরেই। সেই ভিত্তিটার দিকে তাকালে এটুকু বলতে হয় এই দেশ সার্বিক বিচারে আরো অনেক উন্নত হবার কথা ছিল। কথা ছিল এই দেশে দুর্নীতি থাকবে না, থাকবে সুশাসন। কিন্তু তারপরে ক্ষমতায় আসা এরশাদ সরকার এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারটি বীভৎস লুটপাটের মাধ্যমে দেশটার এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। 
শহীদ জিয়া খুব বেশি সময় বেঁচে থাকবেন না, এটা সম্ভবত অনিবার্য ছিল। ক্ষমতার কেন্দ্রে আসার পর থেকেই তিনি রাষ্ট্রের স্বার্থে জাতির স্বার্থে এমন সব পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিলেন যেগুলো বহু মানুষের কায়েমী স্বার্থে আঘাত হেনেছিল। একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং স্মার্ট মানুষ জিয়াউর রহমানের এই ব্যাপারটি না বোঝার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু যে মানুষটি ‘৭১ সালে মানুষকে সাথে নিয়ে নিজে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য, যে মানুষটি ‘৭৫ সালে নিজের জীবন বিপন্ন করে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন, সেই মানুষের অভিধানে ‘ভয়’ শব্দটি না থাকারই কথা। 
ভয় পাননি, তাই জীবন দিয়েছেন, কিন্তু এই ভয় না পাওয়াটাই এমন এক জিয়াকে তৈরি করেছে যেটি এই মাটির মানুষের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে বহু প্রজন্ম পরেও।

লেখক — — ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা রাজনীতিবিদ, আইনজীবী।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com