ফের জয় পাচ্ছে সু চির দল!

0

পূর্ণাঙ্গ সেনাশাসনের অবসানের পর দ্বিতীয়বারের মতো আজ মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিশ্বগণমাধ্যম ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির জনপ্রিয়তায় এবারও তার দল এনএলডি ক্ষমতায় আসবে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতেই গত গতবারের চেয়ে এবার সু চির জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে দেশটিতে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতেই সু চি হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে মিয়ানমার কর্র্তৃপক্ষের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির নেতিবাচক অবস্থান এবং দেশটিতে এবারের নির্বাচনে রোহিঙ্গাসহ প্রায় ২৬ লাখ সংখ্যালঘুকে ভোটাধিকারবঞ্চিত করে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিশ্বগণমাধ্যমেও তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, এর মধ্য দিয়ে সু চি হয়তো জয় পেতে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু রোহিঙ্গা নিপীড়নের কারণে সু চি ইমেজ সংকটে পড়েছেন।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের নির্বাচনে সু চির দলের জয় বাংলাদেশের জন্য কোনোই সুখবর আনবে না। তারা বলছেন, সু চির নেতৃত্বেই মিয়ানমার দেশটিকে রোহিঙ্গাহীন করার উদ্যোগ নেবে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালি উর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সু চি করবেন না। তিনি রোহিঙ্গা নিপীড়নের পক্ষ নিয়ে একের পর এক নির্বাচনে জয়ী হবেন। চীন, ভারত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়েই রোহিঙ্গা বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে এই দুই প্রভাবশালী দেশ যদি বাংলাদেশের পক্ষে থাকে তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন একেবারেই থেমে আছে। এখন করোনার কারণে জয়েন্ট কমিটির বৈঠকও হচ্ছে না। তবে আমরা আশা করছি মিয়ানমারের নতুন নির্বাচনের পর আবার আলোচনা শুরু হবে। 

জানা গেছে, নোবেলজয়ী অং সান সু চি ও তার দল এনএলডি ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করে। ৫০ বছর ধরে সামরিক শাসনে থাকার পর মিয়ানমার পায় প্রথম বেসামরিক সরকার। প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এবারের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন, যার ৫০ লাখই তরুণ ও প্রথমবারের ভোটার। এনএলডি’র সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ৯০টি দল। সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ১৫ লাখ ভোটারকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না। নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কথা বলে সংখ্যালঘুদের ভোটাধিকার থেকে বাইরে রাখা হয়েছে। এরমধ্যে ১৫ লাখ মানুষের মধ্যে এমন অনেক রাখাইন বৌদ্ধও রয়েছেন, যারা ২০১৫ সালে ভোট দিতে পারলেও এবার পারছেন না। এর পাশাপাশি ভোটাধিকারবঞ্চিত ১১ লাখ রোহিঙ্গাও রয়েছেন। এই রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার দুটোই হারিয়েছেন।

ফরটিফাই রাইটস-এর জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ জন কিনলি গণমাধ্যমকে  বলেন, শুধু জাতিগত পরিচয়ের কারণে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার দেওয়া হচ্ছে না। এসব সাহসী, বুদ্ধিদীপ্ত ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হচ্ছে না। কিনলি বলেন, সু চি ও তার দল এনএলডির জন্য হানিমুন অধ্যায় শেষ হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে।’ রোহিঙ্গা রাজনৈতিক দলগুলোকেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হচ্ছে না। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, নির্বাচন ‘মৌলিকভাবে ত্রুটিযুক্ত’। কারণ সংঘাতকবলিত এলাকাগুলোতে অনেক কমিউনিটির মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে দেবে। 

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। সম্প্রতি সেনাপ্রধান এক বিরল সাক্ষাৎকারে তার ক্ষমতার কথা উচ্চারণ করেছেন। অভিযোগ করেছেন, বেসামরিক সরকার নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘অগ্রহণযোগ্য ভুল’ করছে। কমান্ডার ইন চিফ মিং অং হ্লায়াং সেনাবাহিনীকে দেশের ‘অভিভাবক’ বলে উল্লেখ করেন।

এদিকে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংস্কার আনতে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে অল বার্মা ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস ইউনিয়নস। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে সংগঠনটির সদস্যদের কাউকে কাউকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হচ্ছে। পালিয়ে আছেন বেশ কয়েকজন।

এদিকে গতকাল মিয়ানমারের নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দেশটিতে নিজেদের নাগরিকত্ব ফেরত চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন জাতিগত নিধনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নেতারা। তারা মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনের আগে নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার ফিরে পেতে দেশটির নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠির মাধ্যমে কক্সবাজারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ১৪টি সংগঠনের পক্ষ থেকে যৌথভাবে জানিয়েছেন।

মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান হ্লা থেইনের কাছে লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশনের (ইউইসি) উচিত সাধারণ নির্বাচনে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া।

আমাদের উখিয়া প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য মতে, টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আলম বলেন, ইউইসি ও মিয়ানমার সরকার জানিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। অথচ কিন্তু ২০১০ সালের নির্বাচনেও রোহিঙ্গারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় রেজিস্ট্রেশন কার্ড (এনআরসি) এবং পরবর্তী সময়ে সরকারের দেওয়া হোয়াইট কার্ড দেখিয়ে ভোট দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, ২০১৫ সালের নির্বাচনে রোহিঙ্গা বা মুসলিমদের কোনো দল থেকে প্রার্থী হতে দেওয়া হয়নি।

এদিকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরদিন গত ২ জুলাই ইউইসি ঘোষণা করে, বিদেশে বাস করা মিয়ানমারের নাগরিকরা এ বছরের সাধারণ নির্বাচনে অগ্রিম ভোট দিতে পারবেন। ২০১০ ও ২০১৫ সালের নির্বাচনেও প্রবাসীদের ভোটদানের ব্যবস্থা করেছিল মিয়ানমার। এর আগে ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়, নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু শেষ নির্বাচনে সেই কথা রাখেনি মিয়ানমার সরকার।

জানা গেছে, ১৯৮২ সালে সরকারিভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শুরুর আগে যাদের পূর্বপুরুষরা সেখানে ছিলেন, বর্তমানে তারাই শুধু নাগরিকত্ব পাচ্ছেন। এছাড়া দেশটির ১৩৫টি নৃগোষ্ঠীকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এর মধ্যে নৃগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তখন থেকেই রোহিঙ্গারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের চেষ্টা করছেন। এ জাতীয় দাবির কারণেই বারবার তাদের বিতাড়নের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে দেশটির সরকার।

সর্বশেষ ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের ওপর গণধর্ষণ-গণহত্যা চলাকালে নতুন করে আট লাখেরও বেশি নারী-পুরুষ ও শিশু পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এরপরও ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে আছেন, তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে দাবি জনগোষ্ঠীর।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com