চতুর্থ সপ্তাহেও নেই নতুন ছবি…
করোনা মহামারীর কারণে গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সরকারি নির্দেশে সিনেমা হল বন্ধ থাকার পর গত ১৬ অক্টোবর ফের সরকারি নির্দেশে সিনেমা হল খুলে দেওয়া হয়। পরিতাপের বিষয়, সিনেমা হল খোলার চার সপ্তাহ উপনীত হওয়ার পরও প্রযোজকরা নতুন ছবি মুক্তি দিচ্ছেন না। এতে চরম হতাশ সিনেমা হল মালিকরা। তারা সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে দেশীয় নতুন ছবি না পেয়ে এখন বিদেশি ছবি আমদানির জোর দাবি জানাচ্ছেন সরকারের কাছে।
মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার নওশাদ বলেন, নতুন ছবি না থাকায় মধুমিতাসহ আরও বেশ কিছু সিনেমা হল এখনো বন্ধ। এ অবস্থা আর কতদিন। যদি প্রযোজকরা নতুন ছবি মুক্তি দিতে না চান তাহলে সিনেমা শিল্প বাঁচাতে এই মুহূর্তে বিদেশি ছবি আমদানির বিকল্প নেই। সরকারের কাছে আমরা সিনেমা হল মালিকরা এখন জোর দাবি জানাচ্ছি বিদেশি মুক্তি পাওয়া নতুন ছবি এখনই একসঙ্গে এদেশে মুক্তির ব্যবস্থা করা হোক। না হলে আমাদের পক্ষে সিনেমা হলের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জল বলেন, প্রায় সাত মাস পর খুলল সিনেমা হল। ১৬ অক্টোবর থেকে দেশের
প্রায় সিনেমা হলই খুলেছে। ৬৬টি সিনেমা হল খুললেও প্রযোজকরা নতুন ছবি মুক্তি দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। খোলার দিন নতুন ছবি হিসেবে ৩৯টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে শুধু ‘সাহসী হিরো আলম’। ছবিটি দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়। আর ২০টি হলে পুনর্মুক্তি দেওয়া হয়েছে শাকিব খান, নুসরাত ফারিয়া ও রোদেলা জান্নাত অভিনীত ‘শাহেনশাহ’ ছবিটি। একটি হলে মুক্তি দেওয়া হয়েছে শাকিব খান অভিনীত পুরনো ছবি ‘রাজধানীর রাজা’। ২৩ অক্টোবরও কোনো নতুন ছবি মুক্তি পায়নি। ওইদিন মুক্তি পায় শাকিব খান প্রযোজিত ও অভিনীত পুরনো ছবি ‘বীর’। ৩০ অক্টোবরও বস-২ অর্থাৎ পুরনো ছবি দিয়ে দর্শকবিহীন সিনেমা হল চালাতে গিয়ে লোকসানে পড়েছেন সিনেমা হল মালিকরা। গতকাল মুক্তি পেয়েছে শাকিব খান অভিনীত পুরনো ছবি ‘চালবাজ’। সহসা নতুন কোনো ছবি মুক্তির লক্ষণ নেই। এভাবে আমরা আর কত লোকসান গুনব।
সিনেমা হল খুললেও পুরনো ছবি মুক্তি কেন? চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির কাছে এ প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘যখন করোনার কারণে সিনেমা হল বন্ধ ছিল এবং প্রযোজক সমিতির দায়িত্বে ছিল প্রশাসক তখন প্রযোজক সমিতি একাধিকবার প্রদর্শক সমিতির প্রশাসকের কাছে সিনেমা হল খুলে দেওয়ার লিখিত দাবি জানিয়ে আসছিল। অথচ এখন সিনেমা হল খোলার পর তারা নতুন ছবি দিচ্ছেন না। কেন তাদের এই অযৌক্তিক পদক্ষেপ তাও জানাচ্ছেন না। বর্তমানে প্রযোজক সমিতির নির্বাচিত কর্মকর্তারা বহাল আছেন। প্রযোজকরা তো তাদের সঙ্গে সুবিধা-অসুবিধার বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসতে পারেন। তারা তা করছেন না। এ অবস্থায় প্রদর্শকদের সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখতে উপমহাদেশীয় ছবি আমদানি করতে হবে আর না হয় সিনেমা হল বন্ধ করে দিতে হবে। একটি কথা পরিষ্কারভাবে জানাতে চাই, আরেকবার সিনেমা হল বন্ধ হলে তা আর খোলা সহজ হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তার এ প্রশ্নের উত্তরে চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও প্রযোজক-প্রদর্শকদের শতভাগ ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করে কীভাবে সিনেমা হল খোলা যায় সে ব্যাপারে আমরা অনেক আগে থেকেই সরকার, প্রযোজক ও প্রদর্শকদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসার আহ্বান জানিয়ে আসছিলাম। এখনো সেই আহ্বানই জানিয়ে আসছি। কিন্তু প্রদর্শকরা আমাদের আহ্বানে কর্ণপাত না করে একতরফাভাবে সিনেমা হল খুলে দিয়েছেন। আমি বলতে চাই, করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সিনেমা হল খুলতে গিয়ে অর্ধেক আসন খালি রাখতে হয়েছে। এতে একজন প্রযোজক তার তিন কোটি টাকার নতুন ছবি কীভাবে মুক্তি দেবেন। প্রযোজক তো এতে শতভাগ রেন্টাল ও দর্শক অর্ধেক থাকায় মুনাফা দূরে থাক মূলধনই ফেরত পাবেন না। সে জন্য আমরা ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন জানাতে চেয়েছিলাম, সরকার যেন এই ক্ষতি পূরণে ভর্তুকি অথবা প্রণোদনা দেয়। এতে প্রযোজক ও প্রদর্শক উভয়ই আর্থিক ক্ষতির কবল থেকে রক্ষা পেতেন। আমি বলতে চাই, এখনো সময় আছে। প্রদর্শকরা আসুন, আমরা ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করি। তা না হলে এ অবস্থায় কোনো প্রযোজকই লোকসান নিশ্চিত জেনে ছবি মুক্তি দিতে সাহস পাবেন না। প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি ও মধুমিতা সিনেমা হলের অন্যতম কর্ণধার ইফতেখারউদ্দীন নওশাদ তার সিনেমা হল খোলেননি। তিনি বরাবরই বলে আসছেন, নতুন এবং মানসম্মত ছবি না পেলে সিনেমা হল খোলার কোনো মানে নেই। কারণ এমনিতেই বন্ধ সিনেমা হল চালাতে গিয়ে স্টাফদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল, নানা ট্যাক্স নিয়মিত পরিশোধ করতে চরম লোকসানের মধ্যেই আছি। তার ওপর নতুন ছবি ছাড়া সিনেমা হল খোলা মানে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, প্রযোজকরা যদি নতুন ও মানসম্মত ছবি দিতে না পারেন তাহলে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে বিদেশি ছবি একসঙ্গে এ দেশে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করুক সরকার। এদিকে মধুমিতা ছাড়াও বলাকা, জোনাকি, এশিয়া, শ্যামলী, যশোরের ‘মণিহার’, চট্টগ্রামের ‘আলমাস’সহ বড় মাপের প্রায় সব সিনেমা হল ১৬ অক্টোবর খোলেনি। এসব সিনেমা হলের মালিকদেরও একই কথা- ‘নতুন ও ভালো ছবি না পেলে সিনেমা হল কীভাবে খুলব?’ দীর্ঘদিন পর যখন সিনেমা হল খুলল তখন সিনেমা হলে একটি প্রাণবন্ত জোয়ার দেখতে চেয়েছিলেন দর্শক। কারণ সিনেমা হল বন্ধ থাকায় হলে গিয়ে ছবি দেখতে না পারায় ক্ষুধার্ত হয়ে আছেন তারা। তাই তারা এখন নতুন ছবি দেখে সেই ক্ষুধা মেটাতে চেয়েছিলেন। তা না পেয়ে তারা সত্যিই হতাশ। একজন দর্শকপ্রিয় নির্মাতা হিসেবে বলব, দর্শকের দাবি ও প্রযোজক-প্রদর্শকদের চাহিদা কোনোটিই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। দর্শক যেমন নতুন ছবি চান তেমনি একজন প্রযোজকও তার ব্যবসার পূর্ণ স্বার্থ রক্ষার দাবি রাখেন। একই সঙ্গে সিনেমা হল মালিকরাও তাদের ব্যবসা পরিচালনার অনুকূল দিক অবশ্যই চাইতে পারেন। আমার মনে হয় সবকিছুর সমন্বয় হয়নি বলেই হয়তো দর্শক, প্রদর্শক ও প্রযোজক, কেউই কাক্সিক্ষত আকাক্সক্ষা পূরণে সক্ষম হচ্ছেন না। এদিক থেকে সব ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। বললেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমান।
এদিকে, সিনেমা হল খুললেও এপার বাংলায় নেই নতুন ছবি আর দর্শক। অথচ ওপার বাংলাতেও প্রায় সাত মাস পর সিনেমা হল খোলার পর জমে উঠেছে নতুন ছবি মুক্তির রমরমা অবস্থা। এ কথা জানিয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে, ‘দর্শকও সিনেমা হল মালিকদের হতাশ করেনি। জমে উঠছে সিনেমা হল। মুক্তি পেয়েছে ‘ড্রাকুলা স্যার’, ‘রক্ত রহস্য’, ‘গুলদস্তা’, ‘শিরোনাম’, ‘এসওএস কলকাতা’ প্রভৃতি। নবীনা সিনেমা হলের মালিক নবীন চৌখানি জানালেন, তার হলে ‘ড্রাকুলা স্যার’ বেশ ভালো পারফরম করেছে। ‘রক্ত রহস্য’ বা ‘গুলদস্তা’ ফ্যামিলি ড্রামা। যেহেতু কম বয়সীরাই প্রেক্ষাগৃহে ভিড় করেছেন, তাই তাদের আগ্রহ ‘ড্রাকুলা স্যার’ নিয়ে। তিনি আরও বলেন, পূজার কদিনের দর্শক সমাগমে এটা স্পষ্ট যে, মানুষ সিনেমা দেখতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে জরুরি বিষয় হলো কনটেন্ট। ভালো ছবি এলে দর্শকও আসবে। একই কথা বলছেন বেহালার অজন্তা সিনেমা হলের মালিক শতদীপ সাহা। তার কথায়, দর্শকসংখ্যা বাড়াতে গেলে ভালো ছবি দরকার। ‘ড্রাকুলা স্যার’ ভালো পারফরম করেছে বলেই জানালেন তিনি। তারপর ‘রক্ত রহস্য’। আইনক্স মাল্টিপ্লেক্সের তরফেও জানানো হয়েছে, ‘ড্রাকুলা স্যার’ ভালো ব্যবসা করেছে। প্রিয়া সিনেমার মালিক অরিজিৎ দত্তের মতে, সিনেমা হল বাঁচাতে গেলে বড় ছবি প্রয়োজন। সামনে দীপাবলি। ‘প্রেম টেম’, ‘সুইৎজারল্যান্ড’ এবং হরনাথ চক্রবর্তীর নাম ঠিক না হওয়া একটা ছবি থাকবে বলে শোনা যাচ্ছে।