বিএনপি নাই, সরকারি দল তো আছে
জাতীয় দৈনিকে সমসাময়িক সমস্যার ওপর এ লেখকের নিবন্ধ নিয়মিত প্রকাশ পেলেও বিরোধী দলকে কটাক্ষ করে সরকারি দলের মন্ত্রীদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো মন্তব্য লিখি না, যার কারণ বহুবিধ। কারণ রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে প্রতিদিনই বিএনপিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলা হলেও অনুরূপভাবে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক নীতিরীতি অনুসরণ করে তার জবাব দেয়া রাজনৈতিক ভাষায় আলোচনা বা সমালোচনার কোনো মাপকাঠিতে পড়ে না। ঘুরেফিরে সরকারি দলের একই কথা- বিএনপির মুরোদ নেই, বিএনপি গণতন্ত্রের মুখোশপরা ফেরিওয়ালা, বিএনপিকে বাতি জ্বালিয়ে রাজপথে খুঁজে পাওয়া যায় না প্রভৃতি। সরকারের মুখপাত্র এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী গত ২৬ অক্টোবর তার সরকারি বাসভবনে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে এ কথাগুলো বলেন। সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা অনেক কথাই বলেন যাদের গায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা কোনো আইন আঁচড় কাটে না, অন্যদের কোনো লেখনীর প্রশ্নে যা অটোমেটিক্যালি প্রযোজ্য হয়ে যায়।
মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাষ্য মতে, বিএনপিকে রাজপথে লাইট দিয়ে খুঁজে না পেলেও দেশবাসী সরকারি দলকে তো মাথার উপরে খড়গ হিসেবে পাচ্ছে। কোথায় নেই সে দল? সরকারি দলের তুফান থেকে শুরু সিলেটের এমসি কলেজে ধর্ষণের কারা ‘তুফান’ তুলল তা তো দেশবাসী দেখেছে। সাম্প্রতিককালে সংঘটিত ধর্ষণ বা গণধর্ষণে কাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে? তা কি দেশবাসী দেখছে না? নিয়ন্ত্রণে না আনতে পেরে রাষ্ট্রপতি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে অর্ডিন্যান্স নং-৪/২০২০ জারি করেছেন। তারপরও ধর্ষণ-গণধর্ষণ বন্ধ হয়নি। এগুলো কারা করছে? এ ক্ষেত্রে কি অন্য কোনো দলের নেতাদের নাম উঠে আসছে?
‘হাওয়া ভবন’ নিয়ে ক্ষমতাসীন কারো কারো অ্যালার্জি থাকতেই পারে। বর্তমানে তো হাওয়া ভবন নেই, তাহলে বিদেশে এখন কারা অর্থ পাচার বা মানিলন্ডারিং করছে? সরকারি এজেন্সির ভাষ্য মতে, ফরিদপুরের ছাত্রলীগ নেতা দুই হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং করেছে। ক্ষমতাসীন দলের একজন ছাত্রনেতা এত টাকা পেল কোথায়? কোথায় নেই সরকারি দল? ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে কারা ধরা পড়েছে? ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির হাজার কোটি টাকা কারা মানিলন্ডারিং করল? এ সরকারের সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের (বর্তমানে এমপি) ভাষ্য মতে, এই সরকারের আমলে ৯ হাজার কোটি টাকা মানিলন্ডারিং হয়েছে। এগুলো কারা করছে, সরকারি উদ্যোগে তারও একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ হওয়া দরকার। সরকারি দলের মুখপাত্র এ মর্মে কোনো মন্তব্য করবেন কি?
লাইট জ্বালিয়ে রাজপথে বিএনপিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক দেখতে পান না। তার মতে, বিএনপির ‘মুরোদ’ নেই। ‘মুরোদ’ কোনো রাজনৈতিক ভাষা কি না জানি না, তবে একজন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদের কাছ থেকে যদি রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন শব্দ অনুপ্রবেশ করে, দৃষ্টিকটু হলেও বর্তমানে তাতে কী কার কি ক্ষতি? এতে ভুক্তভোগী হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, কারণ বড় বড় নেতারা যা শেখাবেন প্রজন্ম তো তা-ই অনুসরণ করবে। সব ‘মুরোদ’ ঠেকেছে একটি প্লাটফর্মে। বিএনপিতে একজন পাপিয়া আছে (সাবেক এমপি), তাকে তো ওয়েস্টিন হোটেল পাওয়া যায় না, তাকে পাওয়া যায় সুপ্রিম কোর্টে। ওয়েস্টিন নামক বিলাসবহুল হোটেলে কাদের পাওয়া যায় মিডিয়ার বদৌলতে তাদের সাথে তো দেশবাসী পরিচিতি লাভ করেছেন। ওয়েস্টিন পাপিয়ার সাথে কারা কারা সম্পর্কিত তা দেশবাসীর অজানা নয়, মিডিয়াতে আদ্যোপান্ত সবই প্রকাশ পেয়েছে।
আগেই বলেছি, ‘মুরোদ’ওয়ালা নারী-পুরুষ বর্তমানে একটি ছাতার তলে অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ত্রাণ বিতরণ করতে বর্তমান তথ্যমন্ত্রীর এলাকায় গিয়েছিলেন, মহাসচিবকে সেখানে শারীরিকভাবে নাজেহাল করা হয়েছে। ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উদোম শরীরও দেশবাসী দেখেছেন। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মহাসচিবকে শরীর উদোম করে পেটানোর যার ক্ষমতা আছে ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় তাকেই ‘মুরোদ’ওয়ালা বলতে হবে? তবে এ ‘মুরোদ’ওয়ালারাই এক সময় দলের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, এদের বেয়াদবিতে সিনিয়র নেতারাও মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়ে পড়েন, শ্রদ্ধাভাজন সিনিয়র নেত্রী সাজেদা চৌধুরী কাকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশ্যেই ‘বেয়াদব’ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন?
হাজী সেলিমের কথিত জনপ্রিয়তার কথা মানুষ শুনেছে, তার পুত্র কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার কথাও মানুষ জেনেছে। এখন তো জানতে পারছে তিনি কত সহস্র্র কোটি টাকার সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি অবৈধ দখল করেছেন এবং চাঁদাবাজির এখন তিনি কত বড় সম্র্রাট। হাজী সেলিম কোন ক্ষমতাবলে এত শত কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তা-ও দেশবাসী দেখতে পেল। ১৪৭টি খুনের অভিযোগ থাকলেও টেকনাফের কারাবন্দী ওসি প্রদীপের প্রমোশন হয়েছে বলে পত্রিকায় দেখেছি। এ প্রমোশন কি জনগণকে বৃদ্ধাঙুলি দেখানোর নামান্তর নয়?
সরকারি মেগা প্রজেক্টের মেগা চুরির সংবাদ তো প্রতিদিনই পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। মাটির নিচে টাকা, বস্তার মধ্যে টাকা, সিন্দুকের মধ্যে টাকা আর এসব টাকা কাদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে? এরাও কি বিএনপি করে? সরকারি দলের দাপটে এখন বিএনপি ঘরোয়া পরিবেশে ও কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান পালন করতে পারে না। বন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য দোয়া এবং দুস্থদের বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে গত ১৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী খন্দকার বাড়িতে গিয়েছিলেন জাতীয় নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। সেখানে স্থানীয় এমপির নেতৃত্বাধীন সরকারি ‘রাম দা বাহিনী’ মান্নাকে আক্রমণ ও ৪০ জনকে আহত করে স্টেজ, চেয়ার, মাইক, সাউন্ডবক্স ভাঙচুর করে সামাজিক ঘরোয়া অনুষ্ঠানকে পণ্ড করে দিয়েছে। উল্লেøখ্য, ওবায়দুল কাদের এবং মান্না ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রামদা বাহিনী এখন থানা পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করে। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টার খবরে প্রতিটি মিডিয়ায় মান্নার আহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হলেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাত ৯টায় রূপগঞ্জ থানার ওসি বলেছেন, ‘আমি ঘটনা শুনিনি’। একে অপরের দোসর হয়ে যখন কাজ করেন, তখন প্রশাসনে বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা অনুরূপ কথাই বলেন, যা শুনতে দেশবাসী অভ্যস্ত। তবে এর ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছে। যখন ‘ক্ষমতা’ বনাম ‘ক্ষমতা’ (অর্থাৎ উভয় পক্ষ যখন সরকারি হয়) টক্কর লাগে তখন আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। বরং একটু বেশি চলে। তখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ সমস্যায় পড়েন ওবায়দুল কাদেররা। যেমন- ২৬ অক্টোবর নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীকে মারধরের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন সরকারদলীয় প্রভাবশালী এমপিপুত্র যিনি নিজেও দক্ষিণ ঢাকার একজন নির্বাচিত কাউন্সিলর। অনুরূপ ঘটনা যদি এমপিপুত্রের সাথে আমার/আপনার হতো তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা বলতেন, ‘কই কোথায় এ ঘটনা ঘটেছে, আমরা তো তা শুনিনি।’ তখন এমপি বা এমপিপুত্রের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ দূরের কথা, অভিযোগ করলে বরং উল্টো হয়রানি হতো। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে, ওবায়দুল কাদেরের ভাষ্য মতে দেশ ও স্বাধীনতার সুফল একমাত্র ক্ষমতাসীনদের পকেটে। রাষ্ট্র যখন কারো কারো পকেটস্থ হয়ে যায় তখন গরিব আরো গরিব এবং ধনীরা আরো বিত্তশালী হতে থাকে, দেশে অনাচার বৃদ্ধি পায়, আইনশৃঙ্খলা মুখ থুবড়ে পড়ে। বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার পরিবর্তে ব্যক্তির চাটুকারী চলতে থাকে, বাংলাদেশে এখন সে অবস্থাই আছে।
বিরোধী দলকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে এর পরিণাম কী হয় তা একজন প্রজ্ঞাময় রাজনীতিকের অজানা থাকার কথা নয়। তিনি কি এগুলো পর্যালোচনা করতে সক্ষম নন? জনাব কাদেরের সাথে দীর্ঘ দিন একসাথে জেল খেটেছি, ভাগাভাগি করে তার বাড়ি থেকে পাঠানো সুস্বাদু খাবার খেয়েছি। তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমার থাকতে পারে, কিন্তু তার অরাজনৈতিক, অগণতান্ত্রিক মন্তব্য ও বিরোধী দলের প্রতি বিদ্বেষমূলক মন্তব্যকে সমর্থন করা যায় কি?
ক্ষমতাসীন নেতা যথার্থই বলেছেন, বিএনপিকে লাইট জ্বালিয়ে খুঁজে পান না; কারণ তিনি ঠিকানা মতো বিএনপিকে খুঁজতে চান না। কারণ ক্ষমতাসীনরা বিএনপির ঠিকানা করেছে এখন জেলখানায়। হাজার হাজার নেতাকর্মী সরকারসৃষ্ট ‘গায়েবি’ মামলায় জেল খাটছেন, নিরাপত্তাহীনতায় নিজ এলাকায় থাকতে না পারার কারণে অনেক যুবদল নেতাকর্মী ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়ে, হোটেলে বাবুর্চির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সরকারি দল স্থানীয়ভাবে বিএনপির জমি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য দখল করে নেয়ায় বেকারত্বের কষাঘাতে অনেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় কতটি গায়েবি মামলা হয়েছে তা অনুসন্ধান করলেই বিএনপির ঠিকানা এখন কোথায় তা প্রজ্ঞাময় রাজনীতিবিদ ওবায়দুল কাদের সহজেই জানতে পারবেন। তার প্রতিদিনের বক্তব্য জাতি কোন স্কেলে পরিমাপ করছে তা তিনি কি একটু ভেবে দেখবেন?
প্রধানমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বে¡ও ভূমিদস্যুরা, ব্যাংক লুটেরা তিন ফসলি জমি বালু দিয়ে ভরাট করে পরিবেশকে ধ্বংস করছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন উচ্চ আদালতের নির্দেশ কার্যকর করছে না। এটা কিসের আলামত? একটি রাষ্ট্রে কি এভাবে ভূমিদস্যুতা হতে পারে, যেমনটি চলছে রাজধানীর আশপাশে বিশেষ করে রূপগঞ্জ উপজেলায়।
সবারই বিবেচনা থাকা দরকার, এ পৃথিবী থেকে আমরা সবাই চলে যাবো, তবে আমাদের কর্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মন মগজে এবং কথাবার্তা ইথারে ভাসতে থাকবে। আমাদের কর্ম ও কথাবার্তার ওপরই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের মূল্যায়ন করবে। ‘ক্ষমতা’ ও ‘ইতিহাসের পাতা’ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও ইতিহাসে মুদ্রাক্ষরে লেখাগুলো অনেক সময় অনেক নির্মম হয় যা ক্ষমতায় থাকলে বোঝা যায় না। ক্ষমতার দাপটে আমরা যেন ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে না পড়ি, এ জন্য সবার সচেতন থাকা আবশ্যক, নতুবা আঁস্তাকুড় বেশি দূরে নয়। ছদ্মবেশে দেশবাসীকে জিজ্ঞাসা করলেই জনাব ওবায়দুল কাদের সব তথ্য পেয়ে যাবেন। তিনি এটাও জানতে পারবেন, কত পারসেন্ট ভোটার তাদের ভোট দিয়েছেন। আমলা ও বকধার্মিক বুদ্ধিজীবীদের প্রধান কাজ হচ্ছে বাস্তবতার মধ্যে নয়, বরং চাটুকারীর মাধ্যমে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করা, কে বাঁচল, কে মরল বা দেশ বাঁচল কি মরল এতে তাদের আসে যায় না। তবে ক্ষমতার স্বাদ যারা ভোগ করছেন জবাবদিহিতা থেকে তারা কি বাঁচতে পারবেন, নাকি তাদের স্থান আবারো হতে পারে সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, যেমনটি ক্ষমতাসীনরা বিএনপির ভাগ্যে জুড়ে দিয়েছেন? ভাববার সময় কি বয়ে যাচ্ছে না?
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)