১১ স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে তাকে খুঁজছে পুলিশ
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার ফরিদপুর ইউনিয়নের পশ্চিম ফরিদপুর গ্রামের বাসিন্দা নওরোজ হীরা সিকদার। তিনি ফরিদপুর ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য। তাছাড়া একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং আরেকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্যও তিনি।
সেই সুবাদে বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বেতনসহ বিভিন্ন ফি মওকুফ ও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাইয়ে দেয়ার কথা বলে সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। পরে অন্তরঙ্গ ভিডিওচিত্র মুঠোফোনে ধারণ করে সেটি দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করেন। এমনকি সেটাও গোপনে ভিডিও করেন। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ওই ছাত্রীদের অনৈতিক সম্পর্ক রাখতে বাধ্য করতেন তিনি।
সম্প্রতি নওরোজ হীরার সঙ্গে জমি নিয়ে এক প্রতিবেশীর ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে তারা মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় নওরোজ হীরার পকেট থেকে তার মুঠোফোন পড়ে যায়। পরে গ্রামের এক ব্যক্তি ওই মুঠোফোন কুড়িয়ে পান।
মুঠোফোনটির মেমোরি কার্ডে সংরক্ষণ করে রাখা ১১ ছাত্রীকে ধর্ষণের ভিডিও সম্প্রতি গ্রামবাসীর মোবাইল ফোনে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান নওরোজ হীরা।
নওরোজ হীরার কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন এলাকাবাসী। তারা বলেন, নওরোজ হীরা এমন চরিত্রহীন, ভয়ংকর মানুষ সেটা আমাদের জানা ছিল না। সে একাধিক ছাত্রীকে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করেছে। সে একজন সিরিয়াল ধর্ষক। অপকর্মের কারণে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।
এদিকে লোকলজ্জার ভয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রীরাও এ ব্যাপারে কোনো মামলা করেনি। তবে ধর্ষণের বিষয়টি জানাজানি হলে ঘটনার শিকার এক ছাত্রীর (১৬) মা বাদী হয়ে গত বুধবার বাকেরগঞ্জ থানায় নওরোজ হীরার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। নির্যাতনের শিকার আরেক ছাত্রীর স্বজন মৌখিক অভিযোগ করেছেন।
নওরোজ হীরা বাকেরগঞ্জ উপজেলার ফরিদপুর ইউনিয়নের পশ্চিম ফরিদপুর গ্রামের মৃত আব্দুল খালেক সিকদারের ছেলে। হীরা দুই সন্তানের জনক। তবে একাধিক মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের কারণে কয়েক বছর আগে তার স্ত্রী তাকে তালাক দিয়েছেন।
পশ্চিম ফরিদপুর গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, নওরোজ হীরা নিজেকে উচ্চ শিক্ষিত এবং সাংবাদিক বলে পরিচয় দিতেন। বাকেরগঞ্জ উপজেলায় জাতীয় পার্টির অবস্থান বেশ ভালো। নওরোজ হীরা জাতীয় পার্টির নেতা বলে পরিচয় দিতেন।
উপজেলার জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল। নেতাদের আশীর্বাদে মধ্য ফরিদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদ পান তিনি। একইভাবে কারকধা একেএম ইনস্টিটিউশন নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য পদ বাগিয়েছেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় জাতীয় পার্টির এক নেতা বলেন, নওরোজ হীরা নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। তিনি ফরিদপুর ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। নওরোজ হীরা নিজেকে উচ্চ শিক্ষিত বলে পরিচয় দিয়ে আসলেও সম্প্রতি জানা গেছে তিনি এইচএসসি পাস।
প্রায় দুই দশক আগে এক নারীর সঙ্গে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধরা পড়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে ঢাকায় যান নওরোজ হীরা। সেখানে সরকারি একটি হাসপাতালের দালাল চক্রের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে তিনি ওই চক্রের হয়ে কাজ করতে শুরু করেন।
ওই সময় হাসপাতালের এক নার্সের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে বিয়ের প্রলোভনে মেলামেশা করেন। পরবর্তীতে ওই নার্সের স্বজনদের চাপে পড়ে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন নওরোজ হীরা। কয়েক বছর পর বিয়ের কথা গোপন করে এক তরুণীকে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করেন।
একপর্যায়ে ঘটনা জানাজানি হলে এলাকাবসী তাকে ধরে মাথা ন্যাড়া করে দেন। অপকর্মের কারণে স্ত্রীও তাকে তালাক দেন। এরপর গ্রামে ফিরে আসেন নওরোজ হীরা। একটি অনুমোদনহীন অনলাইন পত্রিকার পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন। এরপর নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে উপজেলার জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়েন।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে ১১ ছাত্রীকে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করেছেন নওরোজ হীরা। সম্প্রতি তার ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে পড়লে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি।
বাকেরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন মানিক বলেন, ফরিদপুর ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির কমিটি ভেঙে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ৫১ জন। ওই তালিকায় নওরোজ হীরার নাম থাকতে পারে।
তার অপকর্মের বিষয়টি আমার কানে এসেছে। বর্তমানে আমি এলাকায় নেই। ঘটনা যদি সত্য হয় এলাকায় ফিরে দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে বলেও জানান এই নেতা।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে সোমবার রাতে যোগাযোগ করা হলে নওরোজ হীরার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে তার এক স্বজন অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, রাজনীতি করার কারণে একটি চক্র নওরোজ হীরার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
বাকেরগঞ্জ থানা পুলিশের ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, নওরোজ হীরা নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গত বুধবার এক ভুক্তভোগীর মা বাকেরগঞ্জ থানায় ধর্ষণ মামলা করেছেন। অভিযোগ পাওয়ার পর থেকে আসামিকে ধরতে কয়েকবার ওই এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ নওরোজ হীরাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে। যেকোনো উপায়ে তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।