বিনা বিচারে ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে করতে কিছু পুলিশ এখন স্রেফ দানবে পরিণত হয়েছে
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদের স্মৃতি আমাদের মন থেকে কি কিছুটা (কিংবা অনেকটা) ফিকে হয়ে গেছে? হওয়ারই কথা। এরপর কত কী ঘটলো এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলে, এমসি কলেজে নারীকে নিজ গাড়িতে গণধর্ষণ, বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে নারকীয় নির্যাতনের ভিডিও, সিলেটে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে রায়হানকে মেরে ফেলা। তালিকাটা আরও অনেক দীর্ঘ করা যায়। সেই ঘটনাগুলোর প্রতি ‘দায়’ মেটাতে গিয়ে সিনহা রাশেদের কথা, তার স্মৃতি ফিকে হয়ে যাওয়ারই কথা।
কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ রোডে সিনহা রাশেদের গাড়ি থামিয়ে ইন্সপেক্টর লিয়াকত যখন সিনহা রাশেদকে বেরিয়ে আসতে বলে, তখনই বিপদ টের পান তিনি। মাথার উপরে হাত তুলে লিয়াকতকে কুল থাকতে বলাও যে যথেষ্ট হবে না, বুঝতে পেরেছিলেন। তাই জানান, তিনি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ।
ঘটনাটি যেহেতু জানি আমরা, তাই এটাও জানি কাজ করেনি এই পরিচয়টিও। লিয়াকত হয়ত রাশেদের দেয়া পরিচয়টি বিশ্বাসই করেনি।কিংবা পরিচয়টি সঠিক বা বেঠিক তাতে লিয়াকতের কিছু আসে যায় না। বিনা বিচারে ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে করতে কিছু পুলিশ এখন স্রেফ দানবে পরিণত হয়েছে। তাদের কোন কিছু দু’দ- ভাবার অবকাশ নেই।
সিনহা রাশেদের কথা মনে পড়ল ঘটে যাওয়া আরেকটি ‘ভাইরাল’ ঘটনার পর। সরকার দলীয় এক প্রভাবশালী এমপির গাড়িতে মোটরবাইকের ঘষা লাগার মাশুল দিলেন আরেক জন সশস্ত্র বাহিনী কর্মকর্তা, নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিম।
সরকারি দলের প্রতাপশালী এমপির গাড়িতে মোটরসাইকেলের আঘাত লাগানোর ‘অপরাধে’ সেই গাড়িতে থাকা এমপি পুত্র এবং তার বডিগার্ড মিলে বেদম পিটিয়েছেন সেই লেফটেন্যান্ট এবং তার স্ত্রীকে। পিটিয়ে ওয়াসিমের দাঁত ভেঙে দেয়া হয়েছে।
এটা সিটিজেন জার্নালিজমের যুগ, তাই আমরা সেখানে উপস্থিত একজনের মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও দেখতে পেলাম। জানলাম, ঘটনার সময় ওয়াসিম তার পরিচয় দিয়েছিলেন- আমি লেফটেন্যান্ট ওয়াসিম, নৌ বাহিনী। এই পরিচয় তাকে বেদম মারের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি।
এই দেশের ক্ষমতাসীন দলের একজন এমপি’র সন্তান এবং তার দেহরক্ষীদের মাথা এতই গরম থাকে যে তাদের অতিকায় গাড়িতে আঘাত করার অপরাধ করা কারো কোনো কথা শোনা, কিংবা সেটা আদৌ বিশ্বাস করা কিংবা বিশ্বাস করলেও তা আমলে নেওয়ার মানসিকতা থাকে না।
সিনহা রাশেদ কিংবা ওয়াসিম দু’জনই এই রাষ্ট্রের নাগরিক, তাই খুব ভালোভাবেই জানেন এই দেশের পরিস্থিতি। তাই বাঁচার জন্য উভয়েই দ্রুত বের করে আনেন তাদের মোক্ষম পরিচয়টি – সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
দুইটি ঘটনার মধ্যে একটা জায়গায় খুব স্পষ্ট মিল আছে। সিনহা রাশেদের ঘটনাটির ক্ষেত্রে জড়িত পক্ষটি ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারের প্রশাসনের অংশ। ওয়াসিমের ক্ষেত্রে জড়িত পক্ষটি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী একজন সদস্য।
এই দেশে ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর থেকে সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আর ২০১৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর মধ্যরাতের ব্যালটবাক্স ভরে অতি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করার পর থেকে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এখন প্রায় একচ্ছত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী।
এই রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার আরেকটা অংশ আছে ক্ষমতাসীন দলের হাতে। ক্ষমতাসীন দলের অংশ হতে পারলেই যে কোনো কিছু করা যায় এই দেশে। পৈত্রিক সম্পত্তির মত সবকিছু দখলে নেয়া থেকে শুরু করে যে কোন মুহূর্তে যে কাউকে ধরে পিটিয়ে পঙ্গু করে দেয়া, এমন কি হত্যা পর্যন্ত সবই সম্ভব।
সিনহা রাশেদের গাড়ি যখন লিয়াকত থামিয়েছিল তখন কেন সিনহা রাশেদকে তার সেনাবাহিনীর পরিচয় দিতে হবে? কিংবা ঢাকার রাস্তায় একেবারে তুচ্ছ একটা দুর্ঘটনায় নিজেকে এবং স্ত্রীকে বাঁচাতে কেন ওয়াসিমকে তার নৌবাহিনীতে চাকরির পরিচয় দিতে হবে?
কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে এই রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক যদি ইন্সপেক্টর লিয়াকতের হাতে ধরা পড়তো, বাঁচার জন্য সে কী বলতো? কী পরিচয় দিত নিজের? কিংবা গাড়িতে স্ক্র্যাচ ফেলার ‘অপরাধে’ সাংসদপুত্র আর দেহরক্ষী মিলে যদি বাইকে চড়ে অফিস ফেরত একজন সাধারণ মানুষকে বেধড়ক পেটাতে শুরু করতো, বাঁচার জন্য কী বলতো সে তখন? আর এই ঘটনাগুলোতে যদি থাকতো একেবারে প্রান্তিক কোন মানুষ, তাহলে?
এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কিংবা ক্ষমতাসীন দলের কোনো প্রভাবশালী সদস্যের কাছে ন্যায্য আচরণ পাবেন তিনি এই রাষ্ট্রের নাগরিক বলে। তার আর কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন থাকার কথা না। কথাগুলো লিখেই মনে হলো, ভীষণ কল্পনাবিলাসী কথা লিখে ফেললাম। বর্তমান বাংলাদেশে কথাগুলো আসলেই তাই, কিন্তু এগুলো তো একটা রাষ্ট্রের একবারে মৌলিক ধারণার সাথে যুক্ত।
গত ছয় বছরে এই রাষ্ট্রকে যেদিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, হচ্ছে সেটার উপসর্গ প্রতিবার দেখে শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যায়। প্রতি মুহূর্তে দেখি বাংলাদেশে আদৌ আর রাষ্ট্র নয়। এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো এখন স্রেফ কাগুজে বিষয়ের বাইরে কিছু নয়।
এই দেশে ‘পিপলস রিপাবলিক’ শব্দ দু’টোর মানে কোন এক অদ্ভুত কারণে ‘গণপ্রজাতন্ত্র’ করা হয়েছে। শব্দটির মধ্যে ‘প্রজা’ রয়ে গেছে এখনো। স্বাধীনতার পর থেকেই এই রাষ্ট্রের অধিবাসীরা প্রজা হয়ে থেকেছে, নাগরিক হয়ে ওঠেনি। আর ২০১৪ সালের পর থেকে তারা আর প্রজাও নয়। একজন মধ্যযুগীয় সম্রাটের সাম্রাজ্যের একজন প্রজাও যতটুকু ইনসাফ পেতো, সেটুকুও আর অবশিষ্ট নেই এখন।
-ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা