দেশজুড়ে প্রশ্ন ফাঁসের নেটওয়ার্ক
মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টালে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস সিন্ডিকেটের মাস্টারমাইন্ড স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর ছাপাখানার মেশিনম্যান আবদুস সালাম খান ও তার খালাতো ভাই জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু। প্রশ্ন ফাঁসের লক্ষ্যে গড়ে তোলা টাঙ্গাইলকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্ক দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। দিনাজপুর, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, সিলেট, ময়মনসিংহ, মাগুড়া, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় অন্তত ৪০ জনের চক্র গড়ে তোলা হয়। জসিমের কাছে পাওয়া গোপন ডায়েরিতে এদের নামের একটি তালিকা মিলেছে। টাঙ্গাইলে প্রশ্ন ফাঁস চক্রে দুটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল। একটি এভিস মেডিকেল কোচিং এবং অপরটি ওমেকা কোচিং সেন্টারের টাঙ্গাইল শাখা।
সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে জসিমের দেওয়া তথ্যানুযায়ী- এভিসের নেতৃত্বে ছিলেন উজ্জ্বল সরকার, কাওছার ও ডা. হাবিবুর রহমান। আর ওমেকাতে নেতৃত্ব দিতেন ডা. হিমেল ও তার বাবা কুদ্দুস সরকার। এ ছাড়া তাদের সঙ্গে ছিলেন ডা. মেহেদী। এই চক্রগুলো সারা দেশ থেকে ভর্তিচ্চু শিক্ষার্থী সংগ্রহ করত। পরীক্ষার আগে বাসায় বাসায় ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে চান্স পাইয়ে দেওয়ার চুক্তিতে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করা হতো। এরপর টাঙ্গাইলে ডা. হিমেলে শ্বশুরবাড়ি এবং আরও কয়েকটি বাড়িতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পড়ানো হতো। এমনকি গাজীপুর, টঙ্গী, ঢাকার সেগুন বাগিচা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি বাসাতেও শিক্ষার্থীদের ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সমাধান দেওয়া হতো। জানা গেছে, ২০১৫ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা ছিল ১৮ সেপ্টেম্বর। দিনটি ছিল শুক্রবার। কিন্তু ১৫ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বিকালেই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে আরও একবার র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন মাস্টারমাইন্ড জসিমউদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু। তবে গ্রেফতার হওয়ার আগে সকাল থেকেই সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা চক্রের সদস্যদের হাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র একে একে তুলে দিয়েছিলেন বলে দ্বিতীয়বার গ্রেফতারের পর সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন। ওই ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই তিন দিন পর পরীক্ষা নিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেই সময় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠলেও তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছিলেন কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, জসিম ও তার খালাতো ভাই সালাম ২০০৬ সাল থেকে বারবার প্রশ্ন ফাঁস করেছেন। জসিমের কাছ থেকে পাওয়া গোপন ডায়েরিতে তার চক্রের যাদের নাম পাওয়া যায়, তারা হলেন- রউফ, সুজন, হিমেল, ময়েন, রুবেল, তারেক সুজন, আক্তারুজ্জামান তুষার, সাজ্জাদ, আলমগীর, লতিফ, রাশেদ, সানোয়ার, মোতাহার, ইব্রাহীম, রাশেদ-২, উজ্জ্বল, শাহাদাৎ, আলমাস শেখ, মাহাবুব, মনজু, রওশন হিমু, মমিন, সাদেক, সোহাগ, কাউছার, হাবিব, ডা. মেহেদী, সোহেল, মাসুদ, হেলাল, জামিল, মনন, ডা. ময়েজ উদ্দিন, লিটন, কাইয়ুম, কুদ্দুস, ডা. সালেহীন শোভন ও নিতাই প্রকাশ। ২০১৫ সালে র্যাবের হাতে জসিমের সঙ্গে ডা. শোভনও গ্রেফতার হয়েছিলেন। এরপর দুজনই জামিনে ছাড়া পান।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁস তদন্তের সূত্র ধরে মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের তথ্য পায় সংস্থাটি। গত ১৯ ও ২০ জুলাই রাজধানীর মিরপুর থেকে চক্রের হোতা জসিম, সহযোগী সানোয়ার হোসেন, মোহাইমিনুল ওরফে বাঁধন, জসিমের ছোট বোনের স্বামী জাকির হোসেন দিপু ও ভাতিজা পারভেজ খানকে গ্রেফতার করা হয়। ২০ জুলাই ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করে সিআইডি। এরপর জসিমের বোন শাহজাহী আক্তার মিরা, ভগ্নিপতি আলমগীর হোসেন, সহযোগী মুবিন ও ইমনকে গ্রেফতার করা হয়। রিমান্ড শেষে সানোয়ার, আলমগীর, দিপু, পারভেজ, ইমন ও মুবিন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে সানোয়ার ২০১৩ ও ২০১৫ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা স্বীকার করেছেন। সর্বশেষ গত ৫ অক্টোবর রাজধানীর বনশ্রী থেকে গ্রেফতার হয় অপর মাস্টারমাইন্ড আবদুস সালাম খান।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম এ প্রতিবেদককে জানান, প্রশ্ন ফাঁসে গড়ে তোলা সালামের সম্পদের সন্ধান চলছে। এ ছাড়া তার চক্রের অন্যান্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
যেভাবে ফাঁস হতো প্রশ্নপত্র : ২০১৩ সালের ৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মেডিকেল ভর্তির পরীক্ষার আগের রাতে ১২টার পরে সালাম খান প্রশ্নপত্র এনে দেয় জসিমের কাছে। এরপর জসিম প্রশিকার মোড়ে এসে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য সানোয়ারকে ফাটোকপি করে দেয়। সানোয়ার মোবাইলে ছবি তুলে চক্রের অন্য সদস্য রওশন আলী হিমু, আলমাস এবং সাজ্জাদের ফেসবুকের মেসেঞ্জারে পাঠায়। এদের কাছ থেকে চক্রের আলমগীর, সালেহীন ওরফে শোভন, আক্তারুজ্জামান খান তুষার, রাশেদ খান, মেননসহ দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও খুলনায় থাকা সদস্যরা ফাঁস করা প্রশ্ন দিয়ে পাস করা বহু শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করে। পরের বছর ২০১৪ সালে পারভেজ খান, ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান, রেদওয়ানুর রহমান শোভন হিমু, নেরু, জনি, রিয়াদ শুভ ও নিশাত চক্রের আরও কয়েকজন সদস্য পরীক্ষার আগে থেকে অন্তত ৫০ জন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আগে থেকে টাকা নেয় প্রশ্ন সরবরাহের কথা বলে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া ভর্তি পরীক্ষার আগে সানোয়ার, জাকির হোসেন দিপুসহ চক্রের অন্যরা আগে থেকে সংগ্রহ করা ভর্তিচ্ছুদের কাছ থেকে চেক, টাকা, ভোটার আইডি কার্ড, শিক্ষার্থীদের প্রবেশপত্রের কপি, যোগাযোগের মোবাইল নম্বর ও মেডিকেলে ভর্তির আবেদনের ফটোকপি জসিমের পৃথ্বী ভিলার বাসায় জমা রাখে। এরপর ওই বছর পরীক্ষার আগের রাতে সালামের সহযোগিতায় জসিম তার ভায়রা সামিউল জাফর সিটু ও স্ত্রী শারমিন আক্তার শিল্পীকে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেয়। এরপর শিল্পী চুক্তি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ওই প্রশ্ন পৌঁছে দিত। ওই বছর ফাঁস হওয়া প্রশ্নে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা তাদের কয়েকজনের নাম পেয়েছেন।