করোনায় কোটি টাকার দুর্নীতি
করোনাকালে সরকারি অর্থ ব্যয়ে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য মিলেছে ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। কাপড় ধোলাই, দৈনিক শ্রমিক নিয়োগ, কোয়ারেন্টাইন খাতে ব্যয়, বিধিবহির্ভূত কেনাকাটা, হোটেল বিলে বেশি অর্থ পরিশোধ এবং প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিজ নামেই চেকের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এভাবে শুধু করোনাকালে হাসপাতালটিতে মোট বরাদ্দের ৯৭ লাখ ৫১ হাজার ৯৩৫ টাকার অনিয়ম ও লোকসান হয়েছে। করোনার বিশেষ অর্থ থেকে ব্যয়ের ক্ষেত্রে মানা হয়নি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০০৮, ২০১৬ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা নির্দেশনা এবং বাংলাদেশ ট্রেজারি রুলসসহ সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে সরকারের একটি সংস্থার বিশেষ তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন অসংগতি উঠে এসেছে। তবে কর্র্তৃপক্ষ বলছে, করোনা মহামারীর শুরুতে পরিস্থিতির কারণেই তাদের পক্ষে সবকিছু মেনে চলা ছিল কষ্টসাধ্য।
কাপড় ধোলাই খরচ ২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা : গত ২৫ মার্চ থেকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে কভিড-১৯ ইউনিট চালু করা হয়। এরপর এ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ময়লা কাপড় ধোলাইয়ের জন্য ২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৫ টাকা খরচ করেছে। চলতি বছর ২৮ জুন মেসার্স রাসেল এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে পুরো অর্থও পরিশোধ করা হয়েছে কাগজে-কলমে। যদিও গত ১৫ এপ্রিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী জারি করা অফিস আদেশে খরচের এ খাতটি কোয়ারেন্টাইনবহির্ভূত।
একই হোটেলে অন্য হাসপাতাল থেকে রুমপ্রতি ভাড়া ৬০০ টাকা বেশি : করোনাভাইরাসের সময়ে হোটেল দ্য ক্যাপিটালের সঙ্গে চিকিৎসকদের থাকার জন্য মুগদা জেনারেল হাসপাতাল রুমপ্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়। একই সময়ে ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল চিকিৎসকদের থাকা-খাওয়ার জন্য ওই হোটেলের সঙ্গে রুমপ্রতি চুক্তি করে ৩ হাজার ১০০ টাকা। বিল-ভাউচার থেকে দেখা যায়, রুমপ্রতি দৈনিক ৬০০ টাকা বেশি পরিশোধ করে সরকারি কোষাগার থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা বেশি অর্থ খরচ করা হয়েছে।
দেয়ালে রং, বার্নিশ ও চেয়ার-টেবিল কেনাকাটায় খরচ ২ লাখ ৪১ হাজার টাকা : হাসপাতালটিতে রক্ষণাবেক্ষণের নিজস্ব তহবিল থাকার পরও করোনাকালে দেওয়া বিশেষ বরাদ্দ থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন কেনাকাটা ও অন্যান্য খরচ দেখিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নথিপত্র ও বিল/ভাউচার ঘেঁটে দেখা যায়, কোয়ারেন্টাইন ব্যয় থেকে টেবিল-চেয়ার কেনা, বার্নিশ, দেয়াল রং, প্লাস্টিক পাইপ কেনা, টিন দিয়ে বেড়া তৈরি, গ্যাস সংযোগ, পাইপলাইন মেরামত ও চুলা কেনা বাবদ ২ লাখ ৪১ হাজার ৯০০ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
দৈনিকভিত্তিক মজুরি খরচ ৪ লাখ ৯১ হাজার টাকা : ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে কভিড-১৯-এর চিকিৎসাকাজে নিয়োজিত নার্সসহ কিছুসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য বিসিএস প্রশাসন একাডেমি ও জাতীয় পরিকল্পনা উন্নয়ন একাডেমিতে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে বিধিমতে খাবারের বিলও পরিশোধ করা হয়। কিন্তু এ দুটি প্রতিষ্ঠানে অবস্থানরতদের দেখভালের জন্য দৈনিকভিত্তিক মজুরি দেখিয়ে জনপ্রতি ৬২৫ টাকা করে মোট ৪ লাখ ৯১ হাজার ২৫০ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। বিল-ভাউচার ঘেঁটে দেখা যায়, দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক বলা হলেও সেখানে মাত্র পাঁচজনের নামে এ অর্থ ছাড় করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
৭ বিলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজ নামে তুলে নেন ৩২ লাখ টাকা : কভিড আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের খাওয়া-দাওয়াবাবদ মোট ৩২ লাখ ৩ হাজার ২৭৫ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, যে প্রতিষ্ঠান বিল জমা দেবে সেই প্রতিষ্ঠানের নামে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা চেক ইস্যু করবেন। কিন্তু এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আয়ন ব্যয়ন) নিজ নামেই চেক ইস্যু করে সরকারি কোষাগার থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন।
আনুষঙ্গিক ব্যয় ৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকা : হাসপাতালটিতে করোনা ইউনিট চালুর পর ৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকা আনুষঙ্গিক খরচ দেখিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তিনটি টোকেনের মাধ্যমে পরিশোধ করা এ অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও মানা হয়নি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা নির্দেশনা।
পদে পদে নিয়মের ব্যত্যয় : প্রতিষ্ঠানটির নথিপত্র ও বিল/ভাউচার ঘেঁটে দেখা যায়, করোনাকালে ঢাকা মহানগর হাসপাতালে কেনাকাটাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয়ে মানা হয়নি সরকারের বিধিবিধান। হোটেল দ্য ক্যাপিটালকে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে পিপিআর-২০০৮-এর ১৫(২) ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ হোটেলকে মোট ৪২ লাখ ৩০ হাজার ৫ টাকা পরিশোধে একই আইনের ৭৫(৩) ধারাও লঙ্ঘন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে অর্থ খরচের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা নিজ নামেই বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছেন, যা বাংলাদেশ ট্রেজারি রুলসের প্রথম খণ্ডের ধারা ২৪২(১) লঙ্ঘন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘মহানগর জেনারেল হাসপাতালে ২৫ মার্চ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কভিট ইউনিট চালু ছিল। সেখানে ৫৬ ডাক্তার, ৪৩ জন নার্স ও বেশকিছু স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করেছেন। হোটেল দ্য ক্যাপিটালে ছিলেন ২৫ জন ডাক্তার। আর নার্সসহ অন্যরা ছিলেন সরকারি অন্য প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু যারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ছিলেন তারা সরকার নির্ধারিত টাকা পেয়েছেন।’
এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের জন্য হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক আশরাফুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। আশরাফুল হাসান বলেন, ‘ক্যাপিটাল হোটেলের সঙ্গে চুক্তি সরকারের আরেকটি সংস্থা থেকে করা হয়েছে। সেখানে আমাদের কোনো হাত ছিল না। এর মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানে আবাসন ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে তারা নিজেরা অর্থ পরিশোধ করেছে। এ বিষয়ে আমাদের কিছু করার ছিল না। আর কাপড় ধোলাইয়ের যে বিয়য়টি বলা হচ্ছে, সেখানে পরিস্থিতির কারণে লোকজন পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই কিছুটা বেশি অর্থে এ কাজটি করতে হয়েছে।’