নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচারে উপেক্ষিত আইনে নির্ধারিত সময়সীমা
নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধসমূহ কঠোরভাবে দমনের উদ্দেশ্যে ২০০০ সালে আইন করা হয়। যেখানে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনের সময়ে হাতেনাতে ধরা পড়লে ওই তারিখ থেকে পনের কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। আর হাতেনাতে ধরা না পড়লে অপরাধ সংঘটন সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্য প্রাপ্তি বা ট্রাইব্যুনালের নিকট থেকে তদন্তের আদেশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে ষাট কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে।
আইনে আরও বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে আদালতকে জানাতে হবে। আর এ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা পর্যালোচনার পর আদালত যদি মনে করেন এর জন্য সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাই দায়ী, তাহলে এটি ওই ব্যক্তির অদক্ষতা ও অসদাচরণ বলে বিবেচিত হবে। এমনকি এই অদক্ষতা ও অসদাচরণ তার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করা হবে এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে চাকুরী বিধিমালা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
বিচারের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে, মামলার শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা চলবে। আর মামলা প্রাপ্তির তারিখ থেকে একশত আশি দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না হলে সংশ্লিষ্ট আদালতকে কারণ লিপিবদ্ধ করে ত্রিশ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের নিকট প্রতিবেদন দিতে হবে।
এমনকি পাবলিক প্রসিকিউটর ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকেও কারণ লিপিবদ্ধ করে ত্রিশ দিনের মধ্যে সরকার ও সুপ্রিম কোর্টের নিকট প্রতিবেদন দিতে হবে। দাখিলকৃত প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর যথাযথ কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আইনে উল্লেখ করা হয়।
সুপ্রিম কোর্ট থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশের আদালত গুলোতে নারী ও শিশু নির্যাতনের ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৬১টি মামলা বিচারাধীন ছিল। বিচারাধীন মামলার মধ্যে ঢাকার ৯টি ট্রাইব্যুনালে ১৬ হাজার, চট্টগ্রামের ৭টি ট্রাইব্যুনালে প্রায় ১২ হাজার। আর ভোলার একটি ট্রাইব্যুনালেই ৬ হাজার মামলা। ওই সময় পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৬ টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত ছিল। এরপর গত সাড়ে ৬ মাসে আরও কয়েক হাজার মামলা হয়েছে সারা দেশে।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না হলে সুপ্রিম কোর্টে লিখিত ব্যাখ্যা পাঠানোর বিষয়ে আইনে বলা আছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার সাইফুর রহমান বলেন, ব্যাখ্যা পাঠানোর বিষয়টি জানা নেই। শাখায় খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে।
সম্প্রতি সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আন্দোলনের মুখে সাজা বাড়িয়ে যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদণ্ড করেছে সরকার। তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, কেবল সাজা বাড়ালেই ধর্ষণ বন্ধ হবে না। এর জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করে সৃষ্টি করতে হবে দৃষ্টান্ত। যাতে করে অপরাধীরা অপরাধ করতে ভয় পায়।
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বর্তমানে মুলতবি থাকা মালাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। যারা অপরাধ করে তারা ক্ষমতাসীন দলের আওতায় থাকে। আর তারা ধারনা করে যে, অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে। এ ধারনা দূর করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলমত নির্বিশেষে অপরাধীদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, অপরাধ সংঘটনের পর দ্রুত চার্জশিট দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। তবে নিরপরাধ মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানীর ঘটনাও আমাদের দেশে কম নয়। মিথ্যা মামলায় ৭ বছরের সাজার বিধান আছে। এটিও আরও বাড়ানো উচিৎ। যাতে অযথা কাউকে হয়রানী করা না হয়।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, সাজা বাড়ানোর ফলে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো মিথ্যা মামলা দায়ের হতে পারে। সত্যিকার অর্থে ধর্ষীতাদের ৯০ ভাগই থানার শরনাপন্ন না হয়ে চেপে যান। আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। এটা দিয়ে অপরাধের সুরাহা করা হয়না। এজন্য দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের অপর আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, মৃত্যুদণ্ডকে আমি খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছিনা। মৃত্যুদণ্ড হলেও অনেকে ভয় পাবে না। কেননা এতে অনেক সময় লাগবে। আর দেরী হলে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। তাই দ্রুত চার্জশিট দিয়ে আইন অনুযায়ী সঠিক সময়ে বিচার নিষ্পিত্তি করে উদাহারণ সৃষ্টি করতে হবে।
তিনি বলেন, ধর্ষণের জন্য পৃথক আদালতের প্রয়োজন নেই। নারী ও শিশু নির্যতন ট্রাইব্যুনালেই বিচার করা যাবে। এক্ষেত্রে প্রসিকিউশনকে ধর্ষণের মামলাগুলো প্রাধান্য দিয়ে নিষ্পত্তি করতে হবে। এখানে আন্তরিকতার বিষয়। তবে ধর্ষণ বন্ধ করতে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে জানান খুরশিদ আলম খান।