টাকার খনি সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি!
সিলেট নগরীর দামি পুলিশ ফাঁড়িগুলোর অন্যতম বন্দরবাজার ফাঁড়ি। জনশ্রুতি রয়েছে-বড় অংকের টাকা দিয়ে আসতে হয় এই পুলিশ ফাঁড়িতে।এসআই আকবরও এই পন্থা অবলম্বন করে ফাঁড়িতে আসেন এক বছর দুই মাস আগে।
পোশাকের আড়ালে জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন অপরাধে। লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতন করে টাকা আদায় করে ছেড়ে দেওয়াই ছিল তার অর্থ উপার্জনের অন্যতম পন্থা। তার বিরুদ্ধে ইয়াবা সেবনেরও অভিযোগ করেন অধীনস্থ এক পুলিশ কর্মকর্তা।
অভিযোগ রয়েছে, তার গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দক্ষিণ সুরমা থেকে করিমউল্লাহ মার্কেটের শহীদ নামের এক ব্যবসায়ীকে রেঁস্তোরা থেকে ধরে ফাঁড়িতে এনে নির্যাতন করেন। পরে ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে এসআই আকবরের কবল থেকে মুক্তি পান ওই ব্যবসায়ী।
এছাড়া ফাঁড়ির আওতাধীন আবাসিক হোটেল, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবসা, হকার, সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যাণ্ড, ভাসমান ব্যবসায়ী, তিন তাসের খেলা, ছিনতাইকারী গ্রুপ এমনকি ক্বীন ব্রিজের নীচে পতিতাবৃত্তি থেকেও কাড়ি কাড়ি টাকা আদায় করাতেন তিনি। থানার কর্তা ব্যক্তির কাছেও এসবের ভাগ বাটোয়ারা যেতো। যে কারণে ওসির আজ্ঞাবহ ছিলেন আকবর।
রোববার (১১ অক্টোবর) রায়হান উদ্দিনকে ফাঁড়িতে এনে নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনার পর তার এসব অপকর্ম বেরিয়ে আসতে থাকে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বন্দরবাজার ফাঁড়ির আওতাধীন বিভিন্ন আবাসিক হোটেল থেকে পতিতাবৃত্তির জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা, হকার থেকে ১০ হাজার টাকা, চারটি জুয়ার বোর্ড (শীলং তীর) থেকে ১৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়। ফাঁড়ির অধীনে চারটি জুয়ার বোর্ডের মধ্যে রয়েছে-বন্দরবাজার রংমহল টাওয়ার সংলগ্ন শীলং তীরের বোর্ড চালান সাজ্জাদ নামের এক ব্যক্তি। রাকিব ও ইকবাল নামের দু’জনের অধীনে সুরমা মার্কেট জুয়ার বোর্ড, হকার মার্কেট ও কালিঘাটের বোর্ড চালান কালাম নামের এক ব্যক্তি ও তার ভাই। তাদের মাধ্যমে টাকাও আদায় করতেন এসআই আকবর।
এছাড়া নগরীর কালিঘাটে ভেজাল মসলার বিক্রি থেকে প্রতি সপ্তাহে ৩০/৪০ হাজার টাকা, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবসা থেকে সপ্তাহে ২০ হাজার টাকা, তিন তাসের খেলা থেকে দিনে ৭ হাজার টাকা, ছিনতাই গ্রুপের মাধ্যমে অন্তত ২০/৩০ হাজার টাকা এবং ভাসমান পতিতারা প্রাত্যহিক ২ হাজার টাকা করে ফাঁড়িতে আকবরকে দিতেন। এছাড়াও ভারতীয় পণ্য কসমেটিক সামগ্রী ও সুপারির চালান আটক করে পরে ছেড়ে দিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা কামান তিনি।
সূত্র জানায়, পলিথিনের ব্যবসা থেকে টাকা তুলে এনে দেন কানাইঘাটের দুলু নামের এক ব্যক্তি। যিনি আকবরের ক্যাশিয়ার ও সোর্স হিসেবেও কাজ করেন। ছিনতাইকারীদের কেউ টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাকে ধরে বাজার থেকে ছোরা-চাকু কিনে মামলায় চালান দেওয়া হতো।
তার আগে ফাঁড়ির ইনচার্জ ছিলেন এসআই মো. ইয়াছিন (বর্তমানে তিনি কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার)। তার সময়ে ছিনতাইকারী গ্রুপগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া ফাঁড়ির দায়িত্বে আসার পর নিষ্ক্রিয় থাকা অন্তত ২০ জন ছেঁচড়া ছিনতাইকারী ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে বলেও অভিযোগ মিলেছে। যাদের মাধ্যমে ছিনতাই ঘটিয়ে বাটোয়ারা নিতেন এসআই আকবর। আর এসব টাকায় সুরম্য প্রাসাদ গড়ে তোলেন গ্রামের বাড়িতে। গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। রাতারাতি বনে যান কোটিপতি।
গত রোববার (১১ অক্টোবর) সকালে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রায়হান উদ্দিন মারা যান। তিনি সিলেট নগরের আখালিয়া নেহারিপাড়া এলাকার বাসিন্দা। পুলিশের দাবি ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান। কিন্তু নিহতের পরিবারের লোকজন ও স্বজনদের দাবি বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান উদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এ ঘটনায় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করেছে সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি)।
সাময়িক বরখাস্ত চার পুলিশ সদস্য হলেন- বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাস। আর প্রত্যাহার তিন পুলিশ সদস্য হলেন- এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেন।
তবে ঘটনার পরে ওই দিন সকাল থেকে এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া পলাতক রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সব বর্ডার এলাকায় বেতার বার্তা পাঠানো হয়েছে, যাতে সে দেশত্যাগ না করতে পারে।
এদিকে, নিহতের স্ত্রীর দায়ের করা হত্যা মামলাটি পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) স্থানান্তর করা হয়। মামলার তদন্তে মাঠ নেমেছে পিবিআই। এছাড়া তদন্তের স্বার্থে পুনঃময়না তদন্তের জন্য বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) সকালে মরদেহ কবর থেকে তোলা হবে।