‘আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন শেখ হাসিনা’: হানিফ
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা যত দিন জীবিত আছেন, যত দিন কর্মক্ষম আছেন, তত দিন পর্যন্ত তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে। জননেত্রী শেখ হাসিনাই তত দিন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই থাকবেন। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে কোনো অপশক্তির ক্ষমতা দখল করার শক্তি নেই।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এ নেতার বক্তব্য দেশের অধিকাংশ মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে। ব্যাপক আলোচনাও হয়েছে এ নিয়ে। ফলে ধারণা করাই যায় তিনি এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বক্তৃতার অর্থের ব্যাপকতা সম্পর্কে সম্যক অবগত। তার এ বক্তব্য কোথাও বিকৃতভাবে প্রকাশ হয়নি বলেও মনে হচ্ছে, কারণ সংবাদ প্রকাশের কয়েক দিনেও তিনি ও দল এ নিয়ে কোন প্রতিবাদ জানায়নি, অথবা প্রকাশ-ভঙ্গি নিয়ে আপত্তি জানায়নি, সংশোধনের অনুরোধও জানায়নি।
মাহবুব-উল-আলম হানিফ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। একই সঙ্গে তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় মুখপাত্র।২০১৬ সালের নভেম্বরে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের পর দলটি যে কজনকে দলীয় মুখপাত্র হিসেবে নিয়োগ দেয় তাদের মধ্যে অন্যতম হানিফ। ওই সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, এখন থেকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, ডা. দিপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ এ চারজন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন। তাদের কথা দলের বক্তব্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল ও দীর্ঘ বছর ধরে ক্ষমতাসীন একটি দলের মুখপাত্রের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়ার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। ধারণা করা যায়, তিনি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন এবং সে বক্তব্য দায়িত্ব নিয়েই দিচ্ছিলেন। তবে কথা থাকে এভাবে তিনি বলতে পারেন কি না? কারণ বর্তমানে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এবং বিশ্বব্যাপী এই গণতন্ত্রের সুর হলো ক্ষমতার মালিক হচ্ছে জনগণ, এবং তারাই নির্ধারণ করে ক্ষমতায় কে বসবে।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নির্ধারণ করে না। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে আর প্রতিনিধিরা নির্বাচন করে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। সে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সূত্র ধরে সে সময় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ২০১৪ সালের ‘সংবিধান রক্ষার’ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসে; ফের প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠান যখন তিনি দীর্ঘ নির্বাসন শেষে দেশে ফিরেছেন। দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার নেতৃত্বকালীন আওয়ামী লীগে কোনো ধরনের দল-উপদলের সৃষ্টি হয়নি। এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও দলে ভাঙন ধরেনি। ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের সময়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে বাদ দেওয়ার যে পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছিল সেটাও হয়নি। আওয়ামী লীগে এই অবস্থান শেখ হাসিনার প্রতি দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর ভালোবাসার প্রতিদান।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সুদিন-দুর্দিনের সর্বশেষ আশ্রয়- এটা বারবার প্রমাণ হয়েছে। এখনও হচ্ছে। দলের কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের সকল স্তরেই তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন নেই। এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে-আসলে তিনিই সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি হবেন এটা অনুমিতই। এমন অবস্থায় মাহবুব-উল-আলম হানিফের বক্তব্যকে স্রেফ একটা সাধারণ বক্তব্য মনে করার কারণ নাই, কারণ তিনি সংসদ সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র। তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই।
শেখ হাসিনার প্রতি মাহবুব-উল-আলম হানিফের আনুগত্য শতভাগ থাকতে পারে, কিন্তু তিনি কখনই বলতে পারেন না শেখ হাসিনা যতদিন সুস্থ থাকবেন ততদিন ক্ষমতায় থাকবেন। কারণ তিনি বা একমাত্র আওয়ামী লীগই প্রধানমন্ত্রী কে হবে সেটার চূড়ান্ত নির্ধারক নয়। তিনি বলতে পারতেন জনগণের ভোটের কথা, তিনি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সম্মান জানিয়ে বক্তব্য দিতে পারতেন। কিন্তু সেটা করেননি তিনি। তার মুখ থেকে যে কথাগুলো এসেছে তা স্রেফ একনায়কতান্ত্রিক ধারণা থেকেই। তিনি কি তবে ধরেই নিয়েছেন আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিতে গেছে এবং শেখ হাসিনার জীবিতাবস্থায় আওয়ামী লীগ জিততেই থাকবে? এধরনের ধারণা গণতন্ত্রের ধারণা ও জনগণের ভোটাধিকারের প্রতি স্পষ্টতই অবজ্ঞা ও অবমাননা।
মাহবুব-উল-আলম হানিফসহ বর্তমান সংসদের অধিকাংশই যেখানে দাঁড়িয়ে সে সংসদে প্রতিনিধি পাঠাতে দেশের অধিকাংশ এলাকার ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি। সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য ব্যতীত ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ জন সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত। ওই নির্বাচনের সময়ে বলা হয়েছিল নির্বাচন ‘সংবিধান রক্ষার’; আমাদের সংবিধানও সে বলা কথাকে মানে বলে সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী এটাকে অবৈধ বলা যাবে না। তবে বর্তমান অবস্থার নিরিখে যদি আগামীকেও কেউ বিচারবিশ্লেষণ করে থাকেন তবে সেটা নিশ্চয়ই ঠিক হবে না। আগামীতে এমন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন নাও হতে পারে দেশে; সেক্ষেত্রে মাহবুব-উল-আলম হানিফদেরও ভোট ছাড়াই প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগটা কমেও আসতে পারে।
জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্যে কাউকে যখন জনগণের কাছে ভোট প্রার্থনা করতে হয় তখন জনগণের কাছে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার বিষয়টি পরিষ্কার করতে হয়। অন্যথা হলে কে জনগণ, কেন জনগণ, কীসের জন্যে জনগণ- এধরনের প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাহবুব-উল-আলম হানিফের ক্ষেত্রে কি তেমন ঘটনা ঘটল?
হানিফ যে বিষয়টি বলছেন সেটা আজীবন প্রধানমন্ত্রীর ধারণা। রাজতন্ত্রে এ ধারণার কথা দেখা যায়। এর বাইরে কমিউনিস্ট শাসিত চিনে সম্প্রতি এমন এক পরিবর্তন আনা হয়েছে যেখানে সি চিন পিংকে আজীবন প্রেসিডেন্ট বানানোর আইন করেছে তারা। আওয়ামী লীগের এই মুখপাত্র কি চিনকে এক্ষেত্রে অনুকরণীয় ভাবছেন? যদি ভেবে থাকেন তবে সেটা যৌক্তিক ও কার্যকর হবে না সেটা বলে দেওয়াই যায়।
আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্রের মুখ থেকে যখন ‘যতদিন হাসিনা ততদিন ক্ষমতা’ ধারণার কথা এসেছে তখন একে হালকা করে দেখার সুযোগ নাই। এটা বাস্তবায়ন অপচেষ্টা হোক বা না হোক এনিয়ে আলোচনার দরকার আছে, কারণ ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র যখন প্রকাশ্য সভায় কথাগুলো বলছেন তখন নিশ্চয়ই আড়ালের কোন দুরভিসন্ধি আছে কারও? এর বাইরে থেকে যায় দলের প্রতি আনুগত্যের কথা। মাহবুব-উল-আলম হানিফ এক্ষেত্রে কি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে অবমূল্যায়ন করেন নি? কারণ প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে একদিন সবাইকে পৃথিবী ছাড়তে হয়, অন্য অনেকের মত শেখ হাসিনাও একদিন পৃথিবী ছাড়বেন। সেক্ষেত্রে জনাব হানিফ সহ অন্যরা আওয়ামী লীগ ছাড়বেন? একটা সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের একক নেতা। তাঁর দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই খুনি মোশতাক সরকারের অংশীদার হয়েছিল; অথচ বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতে এরাই তাঁকে একক নেতা হিসেবে মান্য করত।
জনগণ ভোট দিলে শেখ হাসিনা যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন প্রধানমন্ত্রী থাকুন এনিয়ে দ্বিমত নাই, কিন্তু এক্ষেত্রে জনগণই যে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এটা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা দরকার, এটা স্বীকার করা দরকার এবং বিনীতভাবে এটাকে মেনে চলাও দরকার। তা না হলে স্বৈরশাসন, স্বৈরতন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে- যা আমাদের অবশিষ্ট গণতন্ত্রকেও ধ্বংস করে দেবে।
শেখ হাসিনা আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন এ ঘোষণা প্রকাশ্য দাম্ভিকতা। গণতন্ত্রে জনগণের প্রতি বিনয়ের শিক্ষা থাকে, দম্ভের নয়। আওয়ামী লীগ নেতারা দম্ভ ছেড়ে জনগণের প্রতি বিনয়ী হবেন এ আশা বাড়াবাড়ি নয়; গণতন্ত্র আমাদেরকে এধরনের বিষয়ে আশাবাদী হতেই বলে!