আট বছরে এমসি কলেজে কলঙ্কের হ্যাটট্রিক করল ছাত্রলীগ
সিলেটের এমসি কলেজে ৮ বছরে কলঙ্কজনক ঘটনার হ্যাটট্রিক করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একের পর এক ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতার ছত্রছায়ায় তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শুক্রবার রাতে স্বামীকে আটকে রেখে কলেজ ছাত্রাবাসে স্ত্রীকে গণধর্ষণের মতো পৈশাচিক ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দুর্বৃত্তদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১২ সালের ৮ জুলাই সন্ধ্যায় ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের জেরে এতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসে আগুন দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এতে ৪২টি কক্ষ ভস্মীভূত হয়। এ ঘটনায় তৎকালীন শিবিরি সভাপাতিকে মেরে আহত করে তারা।
২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে খাদিজা আক্তার নার্গিসকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন শাবি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা বদরুল আলম।
সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় পুকুর পাড়ে হামলার শিকার হন। এ দুই ঘটনায় সে সময় তোলপাড় হয়।
ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সর্বশেষ ঘটনার পৈশাচিকতা আগের ঘটনাগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করছেন অনেক।
জানা গেছে, ২০১২ সালের ৮ জুলাই সন্ধ্যায় ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের জের ধরে কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসে আগুন দেয়া হয়।
এতে ৪২টি কক্ষ ভস্মীভূত হয়। ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তে ২৯ জনকে দায়ী করা হয়। তাদের মধ্যে ১০ জন ছাত্রলীগের ও ১৯ জন শিবিরকর্মী।
সিলেট নগরীর টিলাগড় এলাকার শতবর্ষী বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজের যাত্রা শুরু ১৮৯২ সালে। বৃহত্তর সিলেটের প্রথম কলেজ দেশের সপ্তম প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও।
১৮৯২ সালে রাজা গিরিশচন্দ্র রায় তার পিতামহ মুরারিচাঁদের (এমসি) নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ আমলে ১৯২০ সালে ৬০০ শতক জায়গার ওপর আসাম ঘরানার স্থাপত্যরীতির সেমিপাকা কাঠামোর ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়।
এ স্থাপত্যরীতির ফলে ছাত্রাবাসটি দেশে-বিদেশে ‘হেরিটেজ’ হিসেবে পরিচিত। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার দুই বছরের মাথায় অবিকল আগের কাঠামোয় ছাত্রাবাস পুনর্র্নির্মাণ করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর।
জানা গেছে, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর বিকালে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে খাদিজাকে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলম।
বদরুলের দাবি, খাদিজাদের বাড়িতে লজিং থাকাকালে তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর খাদিজার পরিবার তা মেনে নিতে পারেনি।
বদরুলকে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। ঘটনার দিন খাদিজার সঙ্গে দেখা করতে বদরুল এমসি কলেজে যান। খাদিজা তার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে বদরুল চাপাতি দিয়ে তাকে কোপান।
প্রায় ৪ মাস ঢাকায় চিকিৎসা শেষে খাদিজা বাড়ি ফিরলেও এখনও তার অবস্থা স্বাভাবিক হয়নি।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মুনিরজ্ঞাতি গ্রামের সাইদুর রহমানের ছেলে বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন।
ঘটনার সময় হামলাকারী বদরুলকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন স্থানীয় জনতা। মামলায় বদরুলের যাবজ্জীব কারাদণ্ড হয়।
এক ছাত্রাবাসেই দখল, সংঘর্ষ, আগুন, দলবদ্ধ ধর্ষণ
২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের জের ধরে ছাত্রলীগ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলো ছাত্রাবাসের ৪২টি কক্ষ। ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর পুনর্নিমিত ছাত্রাবাস উদ্বোধন করা হয়।
এরপর থেকে ছাত্রলীগই এককভাবে ছাত্রাবাসে আবাসিক ছাত্রদের বসবাস নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের পছন্দ-অপছন্দেই সাধারণ ছাত্রদের থাকার সুযোগ পাওয়া নির্ভর করতো। শুক্রবার ছাত্রাবাসের যে ব্লকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেখানে নির্মিত ‘নতুন ভবনটি’ ছাত্রলীগেরই দখলে ছিল। এই ভবনের পাশে তত্ত্বাবধায়কের বসবাসের জন্য নির্ধারিত বাংলোয় প্রভাব খাটিয়ে বসবাস করতো ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি সাইফুর রহমান। শনিবার ভোরে তার কক্ষে পুলিশ অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে।
জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর ছাত্রাবাস খোলার পর থেকে বিভিন্ন কক্ষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যেও বিরোধ ছিল। এজন্য বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রপের সৃষ্টি হয়। ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্রাবাসে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তখন কিছুদিন বন্ধ ছিল ছাত্রাবাস। গত বছরের ৬ আগস্ট রাতে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের কক্ষ দখল নিয়ে ফের ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে মারামারি হয়। ওই সময়ও কিছুদিন ছাত্রাবাস বন্ধ ছিল। এরপর গত ২৫ মার্চ থেকে করোনার কারণে ছাত্রাবাস বন্ধ রয়েছে।
বন্ধের পর আবাসিক ছাত্ররা যার যার বাড়ি চলে যান। আর এই ফাঁকা পরিবেশকে নিজেদের নানা অপকর্মের জন্য মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নিয়েছেন ছাত্রলীগ পরিচয়ধারী কতিপয় শিক্ষার্থী ও তাদের বহিরাগত সঙ্গীরা। তারা প্রভাব খাটিয়ে বন্ধের সময়েও ছাত্রাবাসে বসবাস করছেন।
স্থানীয়রা জানান, সন্ধ্যার পরে ছাত্রাবাসের এসব কক্ষে চলে মদ-জুয়ার আসর। ছিনতাই-চাঁদাবাজীসহ নানা অপকর্মের পরিকল্পনা, ভাগ-বাটোয়ারাও এখানে বসে হয়। ছিল অস্ত্রের মজুদও। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সন্ধ্যায় এমসি কলেজ এলাকায় বেড়াতে যাওয়া এক নব দম্পতিকে তারা ঘিরে ধরে। পরে তাদের ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকে নিয়ে স্বামীকে একটি কক্ষে আটকে পাশের কক্ষে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। মধ্যরাতে পুলিশ ওই দম্পতিকে উদ্ধার করে।
শনিবার সরেজমিনে ছাত্রাবাস এলাকায় গিয়ে আশেপাশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।
ছাত্রাবাস সংলগ্ন বালচুর বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতি রাতে ছাত্রাবাসের ভেতর থেকে হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ শোনা যেত। এখানে মদ-জুয়ার আসর বসাত তারা। শুক্রবার রাতেও এরকম হৈচৈ শোনা গেলেও প্রথমে কেউ তেমন পাত্তা দেয়নি। তারা মনে করেছিলেন, প্রতি রাতের মতো আজো হয়তো মদের আসর বসেছে। পরে নারীকণ্ঠের চিৎকার শুনে তারা এগিয়ে গিয়ে এই নির্মম ঘটনা দেখতে পান।
কলেজসূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই এমসি কলেজ ছাত্রাবাস ছাত্রলীগের দখলে। ছাত্রদের পাশপাশি অনেক অছাত্রও এখানে আস্তানা গেড়েছে। ছাত্রাবাসের ভেতরে নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে কিছু ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। টিলাগড় এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা আজাদুর রহমান আজাদ, রনজিত সরকারসহ কিছু নেতার প্রশ্রয়ে এরা বেপরোয়া। বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত এসব ছাত্রলীগ পরিচয়ধারীরা নানা অপকর্মে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে প্রাণও গেছে অনেকের।