আওয়ামী লীগ নেতার স্ত্রীর নির্যাতনের চিহ্ন দুই শিশুর শরীরজুড়ে
শিশু দুটির শরীরে আগুনে পোড়া ঘায়ের মতো অগুনতি ছোট-বড় কালো দাগ। মাথা থেকে হাত-পায়ের প্রতিটি আঙুল পর্যন্ত ক্ষতবিক্ষত। গরম খুন্তির খোঁচা আর পিটুনির শিকার শিশু দুটি যন্ত্রণাকাতর ছোট্ট দেহ নিয়ে কাতরাচ্ছে হাসপাতালে। শিশু গৃহকর্মীর ওপর বর্বর নির্যাতনের পৃথক এ দুটি ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকা ও শেরপুরের শ্রীবরদীতে।
রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত শিশুটির নাম মনি (১২)। দিনমজুর বাবার নাম আবদুল মোতালিব। বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দুর ইউনিয়নের খামা গ্রামে। অন্য ঘটনাটি ঘটেছে শেরপুরের শ্রীবরদীতে। এ ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব শাকিলের স্ত্রী রুমানা জামান ঝুমুরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ আর নির্যাতিতা ফেলিকে (১০) আশঙ্কাজনক অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
শেরপুর ও শ্রীবরদী প্রতিনিধি জানান, শ্রীবরদী উপজেলায় নির্যাতনের শিকার শিশু গৃহকর্মী ফেলির অবস্থা আশঙ্কাজনক। গত শুক্রবার মধ্যরাতে শিশুটিকে উদ্ধার করে শ্রীবরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসার পর শেরপুর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে গতকাল শনিবার তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শ্রীবরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব শাকিল স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শহরের বিথি টাওয়ারের ষষ্ঠ তলায় ভাড়া থাকেন। প্রায় এক বছর ধরে তাঁর বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত পৌর শহরের মুন্সীপাড়ার সাইফুল ইসলামের মেয়ে সাদিয়া পারভিন ফেলি। শুরু থেকেই শাকিলের স্ত্রী রুমানা জামান ঝুমুর নানা অজুহাতে শিশুটির ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছিলেন। দিন দিন নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। গত ১৫ দিন ধরে টানা নির্যাতনে শিশুটি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে দুই দিন আগে তাকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শিশুটির পরিবার গত শুক্রবার রাতে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে ঘটনা জানালে পুলিশ শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করে। একই সঙ্গে অভিযুক্ত ঝুমুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নির্যাতনের শিকার ফেলি জানায়, শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, তাকে ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হতো না। বাড়ি যেতে চাইলে গৃহকর্ত্রী আরো বেশি মারধর করতেন। মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতেও দিতেন না। আর মারধরের সময় বাসার আর কেউ তাকে থামাতে এগিয়ে আসত না।
ফেলির বাবা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পশুর ওপরও এভাবে অত্যাচার করা হয় না। নেতার বাড়িতে সুখে থাকব, ভালো খাওয়া পাবে, এমন আশায় মেয়েটারে কাজে দিছিলাম। আর ওরা আমার মেয়েরে নির্যাতন কইরা মারার জোগাড় করছে। আমি এর উপযুক্ত বিচার চাই।’
জেলা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা খায়রুল কবির সুমন জানান, শিশুটির সারা শরীরে নির্যাতনের নতুন-পুরনো অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। শরীরের স্পর্শকাতর স্থানও বাদ যায়নি। পেটে পানি এসে গেছে। শিশুটির অবস্থা সংকটাপন্ন।
শ্রীবরদী থানার ওসি মোহাম্মদ রুহুল আমিন তালুকদার বলেন, এ ঘটনায় শিশুটির বাবা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন। মামলার প্রধান আসামি রুমানা জামান ঝুমুরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শেরপুর সদর সার্কেল) আমিনুল ইসলাম জানান, গ্রেপ্তার হওয়া রুমানা জামান ঝুমুরকে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। মেয়েটিকে রক্ষা করতে পুলিশ সার্বিক চেষ্টা চালাচ্ছে।
পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, রাজধানীর আজমপুরের বাসায় নির্যাতনের শিকার শিশু গৃহকর্মী মনিকে তার মা গত ২১ সেপ্টেম্বর ওই বাসা থেকে উদ্ধার করে পাকুন্দিয়ায় নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। গত পাঁচ দিন ধরে শিশুটি হাসপাতালে কাতরাচ্ছে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, পার্শ্ববর্তী তালদশী গ্রামের ইন্নছ আলীর মেয়ে মরিয়ম প্রায় আট মাস আগে মনিকে ঢাকার আজমপুরে রয়েল-জবা দম্পতির বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে নিয়ে দেন। ওই দম্পতি আজমপুর উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। কিছুদিন পর থেকেই নানা বিষয় নিয়ে গৃহকর্ত্রী জবা বেগম মনিকে বকাঝকা ও নির্যাতন শুরু করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন মনি জানায়, ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাকে কাজ করতে হতো। কিন্তু ঠিকমতো খাবার দিতেন না গৃহকর্ত্রী। মাঝেমধ্যে পচা-বাসি খাবার দিতেন। এগুলো সে খেতে পারত না। আর তা নিয়ে কথা বললে নির্যাতন আরো বাড়ত। কোনো কাজে একটু দেরি হলেই গৃহকর্ত্রী জবা বেগম গরম খুন্তির ছেঁকা দিতেন। লাঠি ও রুটি বানানোর বেলন দিয়ে পেটাতেন। এখন ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে সে হাঁটা-চলার শক্তি পাচ্ছে না।
শিশুটির মা নিলুফা বেগম বলেন, ‘খুন্তির ছেঁকা ও মারধরে মেয়ের সারা শরীরে অসংখ্য ক্ষত। পুরো শরীরে পচন ধরে গেছে। আমার সন্তান আবার সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে কি না, তা আল্লাহ জানেন। আমি ওই মহিলার শাস্তি চাই।’
মনির বাবা আবদুল মোতালিব বলেন, ‘আমাদের না জানিয়েই মেয়েকে ঢাকার একটি বাসায় নিয়ে গৃহকর্মীর কাজ দেয় মরিয়ম। মেয়েকে ফেরত চাইলে সে টালবাহানা করে। এটা মরিয়মের ব্যবসা। গ্রামের ছোট ছোট মেয়েদের নিয়ে সে ঢাকার বিভিন্ন বাসায় টাকার বিনিময়ে গৃহকর্মীর কাজ দেয়।’
মরিয়ম বলেন, ‘মনিকে আমি ওই বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে নিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সেখানে ওকে মারধর করা হয়েছে কি না জানি না।’ তবে ওই বাসার পূর্ণ ঠিকানা মরিয়মের কাছ থেকে সংগ্রহ করা যায়নি।’
মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে গৃহকর্ত্রী জবা বলেন, মনিকে মারধর করা হয়নি। সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই ওর মাকে খবর দিয়ে এনে তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বাসার ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
পাকুন্দিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শ্যামল মিয়া বলেন, শিশুটির অভিভাবককে লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তা সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানো হবে।