দেশজুড়ে গ্যাং কালচারের ভয়াল বিস্তার
প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি-ধমকি। দেশি-বিদেশি অস্ত্রের মহড়া। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে ফেসবুকে ভিডিও আপলোড। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা। পান থেকে চুন খসলেই সংঘাত-সংঘর্ষ। ইভটিজিং, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই খুনখারাবি ও চাঁদাবাজি হচ্ছে হরহামেশা। মাদকাসক্ত হয়ে গভীর রাতে চলছে ভয়ঙ্কর গতির নেশা। করোনাকালে এভাবে সারা দেশে গ্যাং কালচারের ভয়াল বিস্তার হয়েছে।
প্রায় প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কিশোর গ্যাংয়ের বিভিন্ন সংঘাতের খবর আসছে। শুধু সংঘাত নয়, প্রায়ই গ্যাং দ্বন্দ্বে খুনখারাবির মতো ঘটনা ঘটছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তারা মূলত পশ্চিমা রীতিনীতি অনুসরণ করেই তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে তাদের কর্মকাণ্ড আরো বেশি বিস্তার হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, সারা দেশের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গতিবিধি, কর্মকাণ্ডের প্রতি নজরদারি করা হচ্ছে।
অনুসন্ধান ও গোয়েন্দা তথ্যমতে, সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের দুই শতাধিক গ্রুপ রয়েছে। এদের মধ্যে ছোটবড় মিলিয়ে দেড় শতাধিক গ্রুপের তৎপরতা আছে। তবে কিশোর গ্যাংয়ের বেশি তৎপরতা ঢাকায়। ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় শতাধিক গ্রুপের কমবেশি অস্তিত্ব ঢাকায় আছে। গোয়েন্দাদের মতে, এই শতাধিক গ্রুপের মধ্যে অর্ধশতাধিক গ্রুপের কর্মকাণ্ড বেপরোয়া। ঢাকার জন্য রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে এদের কর্মাকাণ্ড। এই গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদপুরের ‘পাটোয়ারী গ্রুপ’ ‘আতঙ্ক গ্রুপ’ ‘চাপায়-দে গ্রুপ’ ‘ফিল্ম ঝিরঝির গ্রুপ’ ‘লারা-দে গ্রুপ’ ‘গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ’ ‘লেভেল হাই’ ‘দেখে-ল চিনে-ল’ ও ‘কোপাইয়া-দে গ্রুপ’ উত্তরার ‘পাওয়ার বয়েজ’ ‘নাইন স্টার’ ‘বিগ বস’ ‘নাইন এমএম বয়েজ’ ‘ডিসকো বয়েজ’ ‘রনো’ ‘এনএনএস’ ‘ক্যাকরা’ ‘ডিএইচবি’ ‘জিইউ’ ‘এফএইচবি’ ‘ফিফটিন গ্যাং’ ‘ব্লাক রোজ’ ‘কেনাইন’ ‘ডিসকো বয়েজ’ ‘পোঁটলা বাবু’ ‘আলতাফ জিরো’ ‘ক্যাসল বয়েজ’ ‘ভাইপার’ ‘সুজন ফাইটার’ ‘তুফান’ ‘থ্রি গোল গ্যাং’। ধানমণ্ডির ‘ফাইভ স্টার গ্রুপ’ ‘একে ৪৭’ ও ‘নাইন এম এম গ্রুপ’ রায়ের বাজার এলাকায় ‘মোল্লা রাব্বি গ্রুপ’ ও ‘স্টার বন্ড গ্রুপ’ মিরপুর-১১ এলাকায় ‘বিহারি রাসেল গ্যাং’ মিরপুর-১২ নম্বরে ‘বিচ্ছু বাহিনী’ ‘পিচ্ছু বাবু’ ও ‘সাইফুলের গ্যাং’ সি-ব্লকে ‘সাব্বির গ্যাং’ ডি-ব্লকে ‘বাবু-রাজন গ্যাং’ ধ-ব্লকে ‘মোবারক গ্যাং’ চ-ব্লকে ‘রিপন গ্যাং’ হাজারীবাগে ‘বাংলা গ্যাং’ ও গেণ্ডারিয়ায় ‘লাভলেট গ্যাং’ তেজগাঁওয়ে ‘মাঈনুদ্দিন গ্রুপ’ চকবাজারে ‘টিকটক গ্যাং’ ‘পোঁটলা সিফাত গ্যাং’ তুরাগে ‘তালাচাবি গ্যাং’ কাফরুলের ইব্রাহিমপুরে ‘নয়ন গ্যাং’ দক্ষিণখানে ‘শাহীন-রিপন গ্যাং’ উত্তরখানের বড়বাগের ‘নাজিমউদ্দিন গ্যাং’ আটিপাড়ার ‘শান্ত গ্যাং’ ‘মেহেদী গ্যাং’ খ্রিষ্টানপাড়ার ‘সোলেমান গ্যাং’ ট্রান্সমিটার মোড়ের ‘রাসেল ও উজ্জ্বল গ্যাং’ মুগদায় ‘চান জাদু গ্রুপ’ ‘ডেভিল কিং ফুল পার্টি’ ‘ভলিয়ম টু’ ও ‘ভাণ্ডারি গ্যাং’ এবং বংশালে ‘জুম্মন গ্যাং’ উল্লেখযোগ্য।
কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়স ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। প্রতিটা গ্রুপে ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য থাকে। গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে পাড়া মহল্লার ছিঁচকে চোর, মাস্তান, ছিনতাইকারী, মাদকসেবী, মাদক বিক্রেতা থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী এমনকি অভিজাত ঘরের সন্তানর রয়েছে। তাদের কেউ কেউ পশ্চিমা কালচারে অনুপ্রাণিত হয়ে আবার কেউ কেউ এলাকাভিত্তিক গ্যাংয়ের প্রভাবে বাধ্য হয়ে গ্যাং এ জড়িয়ে পড়ছে। শুরুটা স্বাভাবিক হলেও একসময় তাদের পোশাক, আচরণ, কর্মকাণ্ডে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। যা দেশীয় সংস্কৃতি ও সভ্য সমাজের সঙ্গে একেবারে মানানসই নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিত্যনতুন ধারার অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। বিশেষ করে ঢাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের কর্মকাণ্ড বেশি বেপরোয়া। তারা রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্কুল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, গভীর রাতে মাদকাসক্ত হয়ে কার ও মোটরসাইকেল রেসিং, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর এজেন্ট, শহরের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই এমনকি ভাড়ায় কিলিং মিশনে অংশ নিচ্ছে। একই এলাকায় একাধিক গ্রুপ হওয়াতে আধিপত্য বিস্তারে তারা মরিয়া হয়ে থাকে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তারা প্রায়ই সংঘাত-সংঘর্ষে জড়ায়। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য তারা শক্তিশালী অবস্থান নেয়। দেশি বিদেশি অস্ত্র ব্যবহার করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ্য করে হুমকি দেয়। বিভিন্ন সময় প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর জন্য মারামারির ভিডিও আপলোড করে। কিশোর গ্যাংয়ের নানা সংঘাত খুন পর্যন্ত গিয়ে গড়িয়েছে- এমন ঘটনা অহরহ। ঢাকার শিশু আদালতের তথ্যমতে সারা গত ১৫ বছরে কিশোর গ্যাং ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে প্রায় ৯০টির বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব মামলায় অভিযুক্তরা ১৮ বছরের নিচে হওয়াতে আদালত তাদেরকে কোনো দণ্ড দিতে পারেননি। কিশোর সংশোধনাগারে রেখে তাদেরকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। কারণ আইনে ১৮ বছরের নিচে কাউকে দণ্ড দেয়ার বিধান নেই।
সূত্রমতে, ইন্টারনেটের ও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার কারণে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন, ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপস, ভাইভার ইমোতে গ্রুপ করে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। কর্মপরিকল্পনা থেকে শুরু করে হুমকি, নির্দেশ সবকিছুই তারা ইন্টারনেটের সুবাধে সেরে নিচ্ছে। ইন্টারনেটই তাদের মূল হাতিয়ার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, কিশোর অপরাধ দমনে সাইবার নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। অনলাইনে কিশোর অপরাধীদের কর্মকাণ্ড, গতিবিধি পর্যালোচনা করা হচ্ছে নিয়মিত। যখনই কোনো উগ্র বা হুমকি-ধমকির ঘটনা ঘটছে তখনই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে এখন দেশি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র প্রায়ই দেখা যায়। এসব অস্ত্র দিয়েই তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক দলের নেতারা কিশোরদেরকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছেন। তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন দেশি বিদেশি অস্ত্র। এই সন্ত্রাসীরাই আবার এলাকা ভিত্তিক মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, খুনখারাবির সঙ্গে জড়িত। তাদের এসব কাজেও কিশোরদের ব্যবহার করছেন। একেক সন্ত্রাসী একেকটি কিশোর গ্যাং গ্রুপের মদতদাতা। টাকা, অস্ত্রসহ বিভিন্নভাবে তারা এসব গ্রুপকে সহযোগিতা করছে। এতে করে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাঙের ছাতার মতো গ্রুপ বাড়ছে। একেক এলাকায় ১০/১২টি করে গ্রুপ হচ্ছে। আধিপত্যের বিস্তারের পাশাপাশি সংঘাত, সংঘর্ষ, খুনখারাবি বেড়েই চলছে।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, দেশে গ্যাং কালচারের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। যখন দেশে নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা ও সামাজিক ঐতিহ্যের নিয়মকানুন চর্চা না করে বিদেশি উগ্র সংস্কৃতি সমর্থন ও চর্চা করা হয় তখনই কিশোররা বয়সগত কারণে নিজ দেশের সুস্থ সংস্কৃতি বাদ দিয়ে উগ্র সংস্কৃতির চর্চা শুরু করে। বিদেশি বিভিন্ন সিনেমা, ভিডিও দেখে তাদের চলাফেরা, পোশাক, কর্মকাণ্ডে ভিন্নতা আসে। এমনকি তাদের মধ্যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি উৎসাহ বাড়ে। কিশোর অপরাধের প্রেক্ষাপট দেশ, বয়স, সমাজ ভেদে একেকরকম। অন্য দেশে যে আচরণ স্বাভাবিক বলে গণ্য হয় আমাদের দেশের আইনে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হয়। আমাদের কিশোররা দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো বা একাত্ম করতে পারছে না।
তিনি বলেন, পরিবারগুলোকে তার সন্তানদের সঠিক পথে রাখার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা, শিক্ষা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতাদের একটা কমিটমেন্ট থাকতে হবে যে কিশোরদের কোনোভাবেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা যাবে না। যদি কোনো নেতা কিশোরদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন তবে তার দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে। সর্বোপরি রাষ্ট্র ও সমাজকে কঠোর হতে হবে। যেসব কারণে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে সেব কারণ চিহ্নিত করতে হবে। তা না হলে আমাদের দেশে কিশোর অপরাধ একটি সাধারণ আচরণে পরিণত হবে। এর বাইরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কিশোর অপরাধ দমনে আরো কঠোর হতে হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে গোয়েন্দা পুলিশ সতর্ক আছে। মহানগরীর বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড, গতিবিধি সব সময় গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে। কোন এলাকায় কতটি কিশোর গ্যাং আছে, এসব গ্যাংয়ের সদস্য কারা তার একটি হিসাবও আমাদের কাছে আছে। যখনই কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তারা ঘটায় তখন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, র্যাব অন্যান্য অপরাধ যেভাবে দমন করে ঠিক সেভাবেই গ্যাং কালচারের বিস্তার যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখছে। আমাদের প্রত্যেকটা ব্যাটালিয়নকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন মিটিংয়ে কিশোর গ্যাং সদস্যদের গতিবিধি, কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখতে নির্দেশনা দেয়া হয়।