অনলাইন জুয়ার আসর রমরমা : সর্বস্বান্ত অনেকে, ডেকে আনছে বিপর্যয়
ঢাকার একটি সেলুনে কাজ করেন ইমন শীল। কাজের দিকে মনোযোগ এখন নেই বললেই চলে। দিনভর কোথায় কোন খেলা হচ্ছে তার আদ্যপান্ত খোঁজ রাখছেন তিনি। পাশাপাশি মোবাইলফোন ব্যবহার করে বেটিং ওয়েবসাইটে জুয়া খেলছেন। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার একটি সেলুনের কর্মী ইমন এই জুয়ার নেশায় হারিয়েছেন জমানো লক্ষাধিক টাকা। এখন ধার করে জুয়া খেলছেন।
একই অবস্থা রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকার শাকিল হোসেনের। একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী শাকিল জুয়ায় সর্বস্বান্ত হয়ে দেনায় ডুবেছেন। তার দেনার কারণ ক্রিকেট ও ফুটবল বেটিং। কাজের সময় কাজ ফেলে অনলাইনে জুয়া খেলার কারণে একাধিকবার চাকরিও গেছে তার।
ইমন, শাকিলদের মতো অনেকেই অনলাইন বেটিংয়ে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। অনলাইনে নামে-বেনামে খোলা হচ্ছে এসব ওয়েবসাইট। বাইরে থেকেই দেখলেই বোঝা যায় যে এগুলো ‘বেটিং ওয়াবসাইট’। ওয়েবসাইটের ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় রমরমা জুয়ার আসর। মূলত ক্রিকেট ও ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে চলছে এসব জুয়া খেলা। জুয়া খেলতে টাকা হাত বদলের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা।
একেকটি বেটিং সাইটে জুয়ায় প্রতিদিন লাখ থেকে কোটি টাকা হাত বদল হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখে পড়লে এসব ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা পর পুনরায় অন্য নামে ফিরে আসছে তারা। নিয়মিত ঠিকানা পরিবর্তন করা এসব চক্রকে শনাক্তকরণের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনী।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর দেশে জুয়া খেলা অনেকটা বন্ধ হয়ে এলেও বিদেশ থেকে ডোমেইন খুলে অনলাইন ক্যাসিনো চালানো হচ্ছে বলে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন-র্যাবের মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ।
র্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা দেখছি বিভিন্ন বিদেশি ডোমেইন থেকে এসব অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালিত হচ্ছে। এরকম বেশ কিছু বিষয় আমাদের নজরে এসেছে। এ বিষয়ে র্যাব কাজ করছে।’
অনলাইনে জুয়া খেলার অন্তত ২০টি ওয়েবসাইটের নাম ও তথ্য অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এসব বেটিং সাইটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) এবং আন্তর্জাতিক ও ক্লাব পর্যায়ের ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে চলে বেটিং। এই সাইটগুলো হলো─ ক্রেস্ট ৭১ ডটকম, ওয়ান এক্স বেট ডটকম, বিডি বেট ১০ ডটকম, বেট বকি ডটকম, গেম অন সেভেন ডটকম, গেম ২৪ ডব্লিউ ডটকম, বেট স্কোর ২৪ ডটকম, লাকি বস ৩৬৫ ডটকম, বেট নাও ২৪ ডটকম, ৯ উইকেট ডটকম, বেট ফাস্ট ৩৬৫ ডটইউকে, প্লেস বেট ৩৬৫ ডটইউকে, বেটিন ১০০ ডটকম, বেট বাটারফ্লাই ডটকম, বেলফাস্ট ৩৬৫ ডটইউকে, স্কোর ৬৬ ডটকম, বেটিন ২০ ডটকম, ৬ এন বিডি ডটকম।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি ওয়েবসাইট এক বা একাধিক এডমিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারাই জুয়া পরিচালনা করেন। এসব ওয়েবসাইটে জুয়া খেলতে প্রথমে একটি আইডি তৈরি করতে হয়। এক্ষেত্রে নাম ও মোবাইল নম্বর দিয়ে আইডি খুলতে হয়। পরবর্তী ধাপে টাকা পাঠিয়ে ‘কয়েন’ কিনতে হয়।
ওয়েবসাইটগুলোতে এক বা একাধিক বিকাশ, রকেট ও নগদ নাম্বার দেওয়া রয়েছে। যেখানে টাকা পাঠালে টাকার সমপরিমাণ কয়েন দেয়া হয়। এরপর রেজিস্ট্রেশনকারী সে কয়েন দিয়ে প্রতি খেলায় সর্বোনিম্ন ২০ কয়েন, সর্বোচ্চ যে কোনো পরিমাণ বেট বা বাজি ধরতে পারে।
বাজি ধরার পর জয়ী হলে বিজয়ীর একাউন্টে কয়েন জমা হয়। পাঁচশ কয়েন জমা হলে তা উইথড্র অপশনের মাধ্যমে তুলতে পারবেন জুয়াড়িরা। এক্ষেত্রে এডমিনের কাছে রিকোয়েস্ট করে বিকাশ, রকেট বা নগদ নাম্বার দেয়ার ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টার মধ্যে টাকা পাঠিয়ে দেয় ওয়েবসাইট এডমিনরা।
অনুসন্ধ্যান বলছে, জুয়ার অর্থ লেনদেনের জন্য এডমিনদের কাছে ১০ থেকে ১৫টি করে বিকাশ, রকেট ও নগদ মোবাইল ব্যাংকিং সেবার নাম্বার রয়েছে। বিকাশ, রকেট ও নগদের এজেন্ট সিম নিতে ভুয়া তথ্য, প্রমাণ ব্যবহার করছে এসব ওয়েবসাইট পরিচালকরা।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিফোন রেগুলেটরি কমিশন-বিটিআরসির নজরে এলে এসব ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। তবে বন্ধ করে দেয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই ওয়েবসাইটের ডোমেইন নাম পরিবর্তন করে পুনরায় তারা ফিরে আসছেন।
ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিলেও জুয়াড়িদের জমা রাখা টাকার নিশ্চয়তা দেয় অনেক ওয়েবসাইট। নতুন ডোমেইন নিয়ে ফিরে এসে জুয়াড়িদের জমা থাকা কয়েন ফেরত দিচ্ছে তারা। জুয়াড়িরা বেটিংয়ের জন্য জমা বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া ওয়েবসাইটের সংখ্যাও কম নয়।
জানা গেছে, বেটিং ওয়েবসাইট তৈরিতে পেশাদার ওয়েব ডেভলপার্সদের মাত্র দুই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগে। আর ডোমেইন বন্ধ করে দেয়া হলে ওয়েবসাইটের সঙ্গে নতুন ডোমেইন যুক্ত করতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট। আর প্রতিটি ডোমেইনের দাম সাকল্যে এক হাজার টাকা।
বেটিং ওয়েবসাইটের তথ্য পেলে তা বন্ধ করে দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। মন্ত্রী বলেন, ‘এক্ষেত্রে ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ করে দেয়ার বিকল্প আমার কাছে কিছু নেই। পাশাপাশি আমি যেটা করি, বন্ধ করার পাশাপাশি আমাদের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে বলি, তদন্ত করে অপরাধীদেরকে শনাক্ত করে তাদেরকে যেন ধরা হয়।’
র্যাবের মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, র্যাবের অনুসন্ধ্যানে এ ধরণের নানা চক্রের তথ্য উঠে এসেছে। তাদের ধরতে ফলপ্রসূ অভিযানের প্রত্যাশা করছেন তারা।
আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘এমন কিছু অভিযোগ র্যাবের নজরে এসেছে। যারা অনলাইনে এ রকম ব্যাটিং করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমাদের নজরে এসেছে। তারা বিকাশ এবং রকেট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছে। তারা খুব দ্রুত তাদের ঠিকানা পরিবর্তন করছে। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অনুসন্ধানে দেখেছি ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে সিমগুলো নিয়ে নেয়া। র্যাবের নজরদারী অব্যাহত আছে। আমরা অভিযান চালাবো।’