শত পাত্রের ‘বউ সাজে’ সাদিয়া
কখনো অবিবাহিত যুবক, কখনো বিপত্নীক, কখনো ডিভোর্সি, আবার কখনো বা বয়স্ক পাত্রের বউ হতে চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন। যে পাত্রের জন্য যেমন পাত্রী দরকার, ঠিক তেমনরূপেই নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা; বিশেষ করে ধনাঢ্য পাত্রদের টার্গেট করে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়েই বেশি প্রতারণা করতেন সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস (৩৮)। প্রায় ১০ বছর ধরে শতাধিক পাত্রের সঙ্গে এভাবেই প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। গত শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে দুদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এসব তথ্য উদ্ধার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর রামপুরা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সাদিয়াকে।
গতকাল শনিবার তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা জানান, দৈনিক পত্রিকায় পাত্র চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে সাদিয়ার প্রতারণার অনেক তথ্য মিলেছে। তার কাছে থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরি, মোবাইল ফোন ও সিমকার্ডেই মিলেছে শতাধিক পাত্রের তথ্য। ইতিমধ্যে তদন্তের প্রয়োজনে ওই সব ভুক্তভোগীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে সিআইডি। পাশাপাশি সাদিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার প্রতারণার কৌশল ও প্রতারকচক্রের বাকি সদস্যদের বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের বিশেষ পুলিশ সুপার সামসুন্নাহার বলেন, ‘রিমান্ডের প্রথম দিনে ঠিকমতো কথা বলেননি সাদিয়া। অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছেন তিনি। তারপরও তার কাছ থেকে উদ্ধার করা বিভিন্ন আলামত বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। যেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। তিনি বলেন, ‘সাদিয়ার প্রতারণার অন্যতম সহযোগী তার দ্বিতীয় স্বামীসহ অন্তত আরও চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা বলেন, সাদিয়া খুবই ধূর্ত প্রকৃতির। দ্বিতীয় স্বামীর অবস্থানের যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল, সেখানে অভিযান চালিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মনে হয়েছে, তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, দৈনিক পত্রিকায় একাধিক বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেন এই চক্রের সদস্যরা। সেখানে থাকত যোগাযোগের একাধিক মোবাইল নম্বর। প্রকাশিত বিজ্ঞাপন অনুযায়ী যিনি যোগাযোগ করতেন তার সঙ্গে কথা বলে তার ইচ্ছে জেনে সেই অনুযায়ী প্রতারণার কৌশল ঠিক করতেন তারা। এভাবে প্রায় ১০ বছরে শত শত পাত্রের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের জিজ্ঞাসাবাদকারী আরেক কর্মকর্তা বলেন, সাদিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া বিভিন্ন আলামতের মাধ্যমে শতাধিক পাত্রের সন্ধান মিলেছে। যাদের কাছ থেকে সাদিয়া বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। এখন তার দ্বিতীয় স্বামীকে ধরতে পারলেই প্রতারণার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, সাদিয়ার প্রতারণার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবগুলো শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এসব হিসাব পাওয়ার পর চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে তার আর্থিক লেনদেনের সব তথ্য বের করা হবে। এরপর তার প্রকৃত অর্থের হিসাব জানা যাবে।
সিআইডির আরেক কর্মকর্তা জানান, ইতিমধ্যে তার বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরিতে বিভিন্ন পাত্রের নাম পাওয়া গেছে। তাদের কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছেন সেই হিসাবও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পাত্র হিসেবে যাদের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের বিষয়েও আলাদা হিসাবের তথ্য মিলেছে।
তিনি আরও জানান, সাদিয়াকে যেদিন গ্রেপ্তার করা হয়, ওই দিনই তিনি চারটি ব্যাংকে প্রায় ৪০ লাখ টাকার এফডিআর করেছেন। এ ছাড়া টার্গেট করা পাত্রদের কাছ থেকে সব সময়ই নগদ টাকা নিতেন তিনি। ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা গ্রহণ করতেন না। এ ছাড়া তার বাসা থেকে যেসব জমির দলিল উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলোও যাছাই করা হচ্ছে। যেসব ভুক্তভোগীর পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে, সিআইডির পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন সিমকার্ডে থাকা নাম ও নম্বরের সূত্র ধরে ভুক্তভোগীদের তালিকা করা হচ্ছে। সেই মোতাবেক ডেকে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। তবে ভুক্তভোগীদের অনেকেই প্রতারিত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও নাম-পরিচয় প্রকাশ হওয়ার ভয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
এক সিমকার্ড দিয়ে এক পাত্র : সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, প্রতারণার ক্ষেত্রে খুবই কৌশলী ছিলেন সাদিয়া। একজন পাত্রের সঙ্গে কথা বলার জন্য পৃথক একটি সিমকার্ডই ব্যবহার করতেন তিনি। একটি নম্বর দিয়ে যার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন, সেই নম্বর দিয়ে অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতেন না। টার্গেট করা পাত্রের সঙ্গে কথা বলা ও প্রতারণা শেষ হওয়ার পর ওই সিমকার্ড ফেলে দিতেন। আবার কখনো কখনো মোবাইল ফোন সেটটাও ফেলে দিতেন।
প্রতারণার উদ্দেশ্যেই দ্বিতীয় বিয়ে : কর্মকর্তারা জানান, প্রতারণার উদ্দেশ্যেই দ্বিতীয় স্বামী বরিশালের মুলাদির বাসিন্দা এনামুল হাসান জিসাদকে বিয়ে করেন কুমিল্লার দেবীদ্বারের সাদিয়া। বিয়ের আগে তাদের দুজনের মধ্যে ফেইসবুকে পরিচয় হয়। সেখানেই এই প্রতারণা নিয়ে কথাবার্তা চলে তাদের। বিয়ের পর সংঘবদ্ধ একটি চক্র গড়ে তোলেন তারা। সাদিয়ার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের দ্বিতীয় ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলেমেয়েরা তাদের নানা-নানির সঙ্গে বেড়াতে গেছে বলে সাদিয়া দাবি করলেও মূলত তারা আত্মগোপন করেছে বলেই তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের সিনিয়র সহকারী বিশেষ পুলিশ সুপার জিসান আহমেদ বলেন, প্রতারক সাদিয়া ও তার চক্রের মাধ্যমে শত শত মানুষ প্রতারিত হয়েছেন। যাদের অনেকেই সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগও শুরু করেছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, সাদিয়া-এনামুল দম্পতি মিলে গড়ে তোলেন ৫ সদস্যের চক্র। বাকি সদস্যরা হলেন শাহরিয়ার, ফারজানা ও আবু সুফিয়ান। এ ছাড়া আরও একাধিক ব্যক্তির তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় ‘প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কানাডার সিটিজেন ডিভোর্সি সন্তানহীন পাত্রীর জন্য পাত্র প্রয়োজন। পাত্রীর ব্যবসার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী বয়স্ক পাত্র অগ্রাধিকার’ উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দিতেন সাদিয়া। এ ছাড়া কখনো কখনো অবিবাহিত যুবক ও বয়স্ক পাত্রের জন্যও দিতেন আলাদা বিজ্ঞাপন। যোগাযোগের ঠিকানাও থাকত ভিন্ন ভিন্ন। সবশেষ সাদিয়ার প্রতারণার শিকার হয়ে সিআইডির কাছে অভিযোগ করেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী নাজির হোসেন। এরপর তদন্তের একপর্যায়ে ধরা পড়েন সাদিয়া। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ‘চাঞ্চল্যকর’ এসব তথ্য।