“খুন কইরা স্যারে এহন আত্মহত্যার নাটক সাজাইছে,থানা-পুলিশ সব তাদের কব্জায়”
‘ঘরে খাওন নাই। বড়লোকের ঘরে তিন বেলা ভালো-মন্দ খাইবো, এই ভাইব্যা ঢাকায় কামে পাডাইছিলাম মাইয়াডারে। কিন্তু কী ভাবছিলাম, আর কী হইলো! কাজে লাগনের দুই দিন পর থেইক্যাই ছোট্ট মাইয়াডার ওপর অত্যাচার শুরু করে স্যার-ম্যাডাম। গরুর মতো পিডাইতো, গরম খুন্তি দিয়া ছ্যাঁকাও দিত হেরা। এই মাইর আর থামে নাই। অবস্থা খারাপ দেইখ্যা হাসপাতালেও ভর্তি করণ লাগছে।
মাইয়াডার জীবনডা বাঁচাইতে কাম ছাড়াইয়া কয়েকবার আনতেও গেছি, কিন্তু দেয় নাই। উল্টা স্যার-ম্যাডাম ওরে হুমকি দিয়া কইছে, এইসব (মাইরধর) কতা বাইরে কাউরে কইলে এক্কেবারে জীবনের মতো শেষ কইরা দিব। শেষ পর্যন্ত তাই করলো। মারতে মারতে মাইয়াডারে মাইরাই ফেললো। ঝুলায় রাখলো বাথরুমের রেলিংয়ে। এহন কয় মায়ে আমার আত্মহত্যা করছে।
কন, আমার ১৩ বছরের মাইয়াডা ক্যান আত্মহত্যা করবে? আর ছোট্ট বাথরুমের ওই জায়গায় বইস্যা বইস্যা ও আত্মহত্যা করছে এইডা আমি ক্যান, কেউই বিশ্বাস করবো না। ওরে খুন কইরা স্যারে এহন আত্মহত্যার নাটক সাজাইছে। আমি আমার মাইয়ার খুনের বিচার চাই।’
অশ্রুজড়ানো চোখে গতকাল শুক্রবার বিকালে কথাগুলো বলছিলেন নির্মাণশ্রমিক মো. আইয়ুব আলী। তিনি ১৩ বছর বয়সী হতভাগ্য কিশোরী রোজিনার বাবা। গত ৩০ এপ্রিল রাজধানীর পল্টন থানাধীন চামেলীবাগ এলাকায় গৃহকর্তা মো. কমলের (ট্রাস্ট ব্যাংক কর্মকর্তা) বাসায় ওই গৃহকর্মীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়।
শান্তিনগর ১ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর ভবনের চতুর্থ তলার ওই বাসার বাথরুমে কাপড় রাখার হ্যাঙ্গারের সঙ্গে গলায় ওড়না প্যাঁচানো ঝুলন্ত এবং ফ্লোরে হাঁটু মোড়া অবস্থায় মেলে কিশোরীর নিথর দেহ। মৃত্যুর বিষয়ে গৃহকর্তা কমল বলছেন- রোজিনা আত্মহত্যা করেছে।
আর নিহতের বাবা আইয়ুব আলীর দাবি, হত্যার পর তার মেয়েকে বাথরুমে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা বলে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী। অনেক ঘুরেও পুলিশের সহযোগিতা না পেয়ে অবশেষে মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন হতভাগ্য এই পিতা। তার অভিযোগ আমলে নিয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস ঘটনাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন।
আইয়ুব আলী জানান, বছর দুই আগে ট্রাস্ট ব্যাংক কর্মকর্তা মো. কমলের বাসায় রোজিনাকে গৃহকর্মীর কাজে দেন তিনি। সামান্য বিষয়েও ছোট্ট মেয়েটিকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন কমল ও তার স্ত্রী তানিয়া। নির্যাতনের কথা বাবা ও বোনকে জানায় রোজিনা। এই নিয়ে অনেক দেনদরবারও হয়। ঘটনা বাইরে জানাজানি হওয়ায় ক্ষেপে গিয়ে ওই দম্পতি ঘুমের মধ্যে বালিশচাপা দিয়ে হত্যার হুমকি দেন মেয়েটিকে।
এমনকি মা আসমা খাতুন মেয়েকে আনতে গেলে উল্টা হুমকি দিয়ে বলা হয়- ‘তোর মেয়ের লাশ নিতে পারবি, কিন্তু জীবিত নিতে পারবি না।’ থানা-পুলিশ সব তাদের কব্জায়। পরে রোজিনাকে আটকে রেখে চামেলীবাগের ওই বাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় মা আসমাকে।
মারা যাওয়ার আগের দিন গত ২৯ এপ্রিল রাতেও রোজিনাকে পেটায় গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী। সেদিন রাত ১০টার দিকে কাঁদতে কাঁদতে মারধরের কথা জানিয়ে এই বাসা থেকে নিয়ে যেতে বোন আলেছা বেগমের কাছে অনুরোধ জানায় সে। পরদিন সন্ধ্যায় তাকে নিতে ওই বাসায় গেলে মা আসমাকে জানানো হয়, রোজিনা আর বেঁচে নেই। বাসার নিচে কাপড় দিয়ে ঢাকা অবস্থায় মেলে কিশোরী গৃহকর্মীর নিথর দেহ। তার মাথায় রক্তাক্ত জখম ও বুকে-পিঠে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান স্বজনরা।
মেয়ের হত্যার অভিযোগ তুললে, তাদের আটকে রাখা হয়। এর পর ব্যাংক কর্মকর্তাসহ কয়েকজন তাদের পল্টন থানায় নিয়ে গিয়ে ধমকিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রেখে ছেড়ে দেয়। পরে থানায় হত্যা মামলা করতে গেলেও তা নেওয়া হয়নি। উল্টা মো. কমল ও তার লোকজন নিহতের পরিবারকে হত্যার হুমকি দিয়ে জানায়, এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে রোজিনার মতোই পরিণতি হবে তার মা-বাবা-বোনেরও।
রোজিনার বাবার অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে গতকাল ব্যাংক কর্মকর্তা মো. কমল বলেন, ‘ঘটনাটি তদন্ত করছে পল্টন থানাপুলিশ।’ তবে ওই রাতে কী ঘটেছিল তার বিস্তারিত জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি, ‘এ বিষয়ে থানাপুলিশের সঙ্গে কথা বলুন।’
পল্টন থানার ওসি আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘গৃহকর্মী রোজিনার লাশ উদ্ধারের পর তার পরিবারের কেউ হত্যা মামলা করতে চায়নি। পরে ওই ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। তবে লাশের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলেই জানা যাবে কীভাবে রোজিনা মারা গেছে।’