শুটারদের লাগেজে আসে ‘অবৈধ’ অস্ত্র গুদামের গুলির হিসাবে হেরফের
বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের (বিএসএসএফ) শুটারদের লাগেজে বিদেশ থেকে অবৈধ অস্ত্র আসার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির গুদাম থেকে পাওয়া গেছে অস্ত্র-গুলি গায়েবের অভিযোগ। সেই অস্ত্রের মধ্যে কিছু অস্ত্রের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কিছু গোলাবারুদ বেশি পাওয়া গেছে। বিষয়টি তদন্ত করছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ফেডারেশনের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য শুটিং সরঞ্জাম সংরক্ষণাগার যাচাই প্রতিবেদন ও শুটিং ফেডারেশনের অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অস্ত্র সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের হাতে চলে যেতে পারে। যা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করবে।
এছাড়া ফেডারেশনের জন্য ১০টি টার্গেট চেঞ্জার কিনে প্রায় দুই কোটি টাকা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের মহাসচিবের দুর্নীতি ও নানা অনিয়ম তদন্তের জন্য বিএসএসএফ সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী গত বছরের ৯ই আগস্ট একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন হোসনে আরা। ওই কমিটির সদস্য ছিলেন ইয়াসমিন গফুর ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ। কমিটি গত এপ্রিলে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনের ১৭ নম্বর পাতায় মাহফুজা জান্নাত জুঁই নামে একজন শুটার তার সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন ‘২০১৭ সালের মে মাসে আইএসএসএফ (ইন্টারন্যাশনাল শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশন) ওয়ার্ল্ড কাপে অংশ নিতে যাই। আমার সঙ্গে ছিলেন রিসালাত, মুন্না, বাকী, আনোয়ার ও শালিক। আমাদের সঙ্গে আরো ছিলেন কোচ ক্লাউস মার্কো ও ফেডারেশনের মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপু। শুটিংস্থলের পাশে বিভিন্ন কোম্পানির দোকান বা মেলা ছিল।
প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পর আমাদের উপস্থিতিতে ফেডারেশনের ইন্তেখাবুল হামিদ অপু ৬টি ওয়ালথার এলজি ৪০০ মডেলের রাইফেল কিনেন। বাংলাদেশে পৌঁছার পর বিমানবন্দরের ভিআইপি গেট দিয়ে আমরা বের হয়ে ওই অস্ত্রগুলোসহ শুটিং ফেডারেশনে আসি। ৩-৪ মাস পর আমি ব্যক্তিগতভাবে ২ লাখ ২০ হাজার টাকায় কেবিএ ২০৬৯ এলজি ৪০০ ওয়ালথার অস্ত্রটি কিনে নেই। ফেডারেশনের হিসাবরক্ষক বারেকের নিকট থেকে অস্ত্র বুঝে নেই। অস্ত্রটির সঙ্গে আমাকে টাকার কোনো রশিদ বা কাগজপত্র দেয়া হয়নি। অন্য অস্ত্রগুলোর মধ্যে রিসাল, মুন্না ও দিশা একটি করে পেয়েছেন। অন্য দুটি অস্ত্রের বিষয়ে আমার জানা নাই।
বিমানবন্দরের ভিআইপি গেট ব্যবহার করে ঘোষণা ছাড়াই প্রাণঘাতী অস্ত্র আনার বিষয়টি তদন্ত করছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘শুটারদের লাগেজ ব্যবহার করে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই অস্ত্রগুলো অবৈধভাবে আনা হয়েছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। তদন্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। এর বাইরে ওই কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।’
জানা গেছে, বিএসএসএফের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য শুটিং সরঞ্জাম সংরক্ষণাগার যাচাই কমিটির চার সদস্যের প্রতিবেদনে বেশ কিছু অস্ত্র গুলি গায়েব হওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘এয়ার পিস্তল হামারলী এপি-২০ এর স্টক প্রতিবেদেনে ৩টি থাকলেও গুদামে পাওয়া যায় ২টি। একইভাবে এয়ার রাইফেল হামারলী এআর-২০ স্টক প্রতিবেদনে ৬টির স্থলে ৫টি পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে কর্মকর্তারা তদন্ত কমিটিকে বলেন, ২ জন শুটার সেগুলি ব্যবহার করছেন। কিন্তু, এর কোনো বরাদ্দ তারা দেখাতে পারেনি। এছাড়া গুদামে রেমিংটন নম্বর ৬, ৩৬ গ্রাম ৬০টি গুলি স্টকে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে আরসি নম্বর ৬, ৩৬ গ্রাম ৬০টি গুলি।
সূত্র জানায়, পিস্তলের ম্যাগাজিন এ রমনা ১০ শর্ট ২টির স্থলে পাওয়া গেছে ৪টি, এসঅ্যান্ডডব্লিউ পিস্তল ম্যাগাজিন নম্বর ৬৫২ এর ৫টির স্থলে পাওয়া গেছে ৩টি। এ ছাড়া ২২৮টি পাপুয়া প্লিঙ্কার গুলি, ২০০ পাপুয়া র্যাপিড ফায়ার শর্ট গুলি, ২০টি আরসি ৪ স্পোশাল ৩৩ গ্রাম গুলি, ৭৫টি আরসি মাগনাম ৪২ গ্রাম গুলি পাওয়া যায়নি। আবার লাপুয়া সুপার গুলি ১৪২৮টি বেশি পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর জাতীয় শুটিং প্রতিযোগিতায় ১২ বোর স্কীট গুলির ১০০০ চাহিদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু, সরবরাহ করা হয়েছে ১০৩৬টি। ওই চাহিদাপত্রে মহাসচিবের স্বাক্ষর নেই এবং ৩৬টি গুলি দেয়ার ক্ষেত্রে গ্রহীতার স্বাক্ষর নেই। একই বছর ১লা মার্চ পয়েন্ট ২২ বোর গুলি এক হাজারের স্থলে রেজিস্ট্রারে ২০০০ লেখা রয়েছে।
সূত্র জানায়, ১৯শে নভেম্বর ২০১৪ সালে ৩০০টি ১২ বোর গুলি বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু, স্টক বইতে ২৫০টি দেখানো হয়। অপর ৫০টির হদিস নেই। ২০১৪ সালের ২৪শে মার্চ ১০০০ এর পেলেট বরাদ্দ করা হয় যা স্টক বইতে ১২০০ দেখানো আছে।
শুটিং ফেডারেশনের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘সংস্থাটির মহাসচিবের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘ডেলকো’ শুটিং ফেডারেশনের ১০ মিটার শুটিং রেঞ্জার স্থাপন করে। প্রতিটি রেঞ্জারের দাম নিয়েছে ২৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এর মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয় প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, পরবর্তীতে ফেডারেশন একই টার্গেট চেঞ্জার ভিশন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি ক্রয় করে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ১২৪ টাকায়। তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ফেডারেশন ভবন আধুনিকায়নের জন্য ৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা, রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের বিদেশি খোলোয়াড়দের ডরমেটরি সংস্কারে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বিএসএসএফ সভাপতি নাজিমুদ্দীন চৌধুরী জানান, সরকারি অনুমতি ছাড়া কিছু অস্ত্র আসছে সেটি নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তদন্ত করছেন।