বিএসএফের সহযোগিতায় বেনাপোল সীমান্ত পথে পাচার হচ্ছে মাদক ও অস্ত্র
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিএসএফ’র প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় যশোরের বিভিন্ন সীমান্ত পথে ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্য বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। যশোরের ৭০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট বিজিবি বিওপি ও টহলরত সৈনিকের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও চোরাকারবারীরা চোরাগুপ্তা পথ দিয়ে মাদকের চালান নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গত এক বছরে এ সীমান্ত পথে ব্যাপক বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ স্বর্ণ আটক করেছে বিজিবি। এসময় বিভিন্ন মাদকদ্রব্য পাচারের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০৩ জনকে আটক করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
আসামিদের আইনের আওতায় আনলেও কয়েকদিন যেতে না যেতেই আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে। এসব চোরাকারবারীরা আবার জেল থেকে বেরিয়ে এসে নতুন উদ্যোমে মাদক পাচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এসব সীমান্ত পথে ভারত থেকে কোনো মাদকদ্রব্য ও অস্ত্রের চালান বাংলাদেশে যাতে প্রবেশ করতে না পারে এবং দেশ থেকে কোনো কিছু ভারতে না যেতে পারে সেজন্য বিজিবি কর্তৃক নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করছেন। বিজিবি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ পাচার বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সীমান্তে বসবাসরত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো করোনাভাইরাস চলাকালীন সময়ে অন্য কোনো কাজ না পেয়ে সীমান্ত এলাকায় সহজে বহনযোগ্য ও লাভজনক ফেনসিডিল এবং স্বর্ণ পাচারের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন বলে বিজিবি সূত্রে জানা গেছে।
বিভিন্ন সময়ে অভিযানে বিজিবি যশোরের শার্শা-বেনাপোল সীমান্ত থেকে গত ১ বছরে ১৩টি পিস্তল, ২৪টি ম্যাগজিন, ৫৮টি গুলি, ২৫.৪১ কেজি স্বর্ণেরবার, ২০ হাজার ৮২৭ বোতল ফেন্সিডিল, ৫৪৭ কেজি গাজা, ৪০৬ বোতল মদ, ৫৬৭ টি ইয়াবা, ৪০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। এ সময় এসব মাদক পাচারের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০৩ জনকে আটক করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। উদ্ধারকৃত সামগ্রীর মূল্য ১৭ কোটি ৭৫ লাখ ৪০ হাজার পাঁচ শ’ টাকা।
সীমান্তবর্তী সাদিপুর গ্রামের পৌর কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান বকুল জানান, যশোরের সাথে ভারতের প্রায় ৭০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। বাংলাদেশের এসব সীমান্তের বিপরীতে ভারত সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোতে ফেন্সিডিলের ছোট ছোট কারখানা তৈরি হয়েছে যেটা ভারতীয় পুলিশ এবং বিএসএফ জানেন। এসব অবৈধ মাদকদ্রব্য এখানে তৈরি হচ্ছে সেটা ভারতীয় প্রশাসনের নজরে থাকলেও তারা কিছু বলছেন না। ভারতীয় প্রশাসন চায় যে মাদক দ্রব্য ফেনসিডিল গাঁজা হেরোইন এগুলো সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করুক। তারা বাংলাদেশে এ ধরনের মাদকদ্রব্য পাচার করার সহযোগিতা করে এজন্যই যে বাংলাদেশের যুব সমাজ যাতে ধ্বংস হয়ে যায়। একটা পরিবারে একটা মাদকসেবী থাকা মানে সেই পরিবারটা ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া। সমাজে একটা পরিবার যখন ধ্বংস হয় তখন ক্রমান্বয়ে সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে আস্তে আস্তে বিস্তার লাভ করে। আর আমাদের সমাজকে ধ্বংস করার সহযোগিতা করছেন ভারতীয় পুলিশ প্রশাসন ও বিএসএফ। তাদের প্রশাসন যদি সীমান্ত এলাকায় গড়ে ওঠা ফেন্সিডিলের ছোট ছোট কারখানাগুলি ধ্বংস করে দিত তাহলে ফেন্সিডিলের চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করতো না। আবার সেখানে নাকি গাঁজার চাষ অবাধে হয়ে থাকে। ভারতীয় প্রশাসন এ তথ্য জানলেও তারা কিছু বলেন না। সাধারণত সীমান্ত এলাকার মাঠগুলোতে গাঁজা চাষ হয়ে থাকে যাতে সহজে বাংলাদেশে পাচার করা যায়। এসব সীমান্ত দিয়ে মাদকদ্রব্য ফেনসিডিল গাঁজা চালান প্রবেশ বন্ধ করার কাজ বিজিবি ও পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে যদি এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় তবেই এসব মাদক আসা বন্ধ করা সম্ভব। নতুবা এই মাদক কখনো ভারত থেকে আসা বন্ধ করা সম্ভব নয়।
বেনাপোল পুটখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাদিউজ্জামান জানান, আমাদের পুটখালী সীমান্ত দিয়ে মাঝে মাঝে ফেনসিডিলের চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বিজিবির হাতে ধরাও পরে তারা। তখনই বোঝা যায় যে, আসলে ফেনসিডিল ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে। বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। সংসার চালাতে এখন সহজ পথ হিসেবে ভারত থেকে ফেন্সিডিল আনাটাই তারা বেছে নিয়েছে। কম সময়ে বেশি টাকা পাওয়া যায় বলেই তারা এই পথে এখন নেমেছে। তবে এসব ফেনসিডিলের চালান যারা ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে এরা অরজিনাল ফেন্সিডিলের মালিক নন, এরা আসলে বহনকারী। এরা ব্যাগ প্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকার কারণে এসব ফেনসিডিলের চালান ভারত থেকে নিয়ে আসে। ফেন্সিডিল বা অন্য কোনো মাদক যাতে এসব সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য বিজিবি কঠোর পরিশ্রম করে থাকেন। মাদকদ্রব্য যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য বিজিবি সীমান্ত এলাকায় এখানে আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে। নদীতে টহল দেয়ার জন্য হাই স্পিড বোর্ড ব্যবহার করা হয়, কাদা মাটিতে চলার জন্য আধুনিক মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়, রাতে চোরাকারবারীদের দেখার জন্য নাইট ভিশন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। আসলে এ সীমান্ত পথে ভারতীয় বিএসএফ মাদকের বিরুদ্ধে একটু প্রতিরোধ করলে বাংলাদেশে ফেন্সিডিল সহ অন্যান্য মাদক দ্রব্য প্রবেশ করতো না। কেউ গরু আনতে ভারত সীমান্তে গেলে বিএসএফ তাদের গুলি করে মেরে ফেলে। অথচ আজ পর্যন্ত কখনো শুনিনি কোনো মাদক পাচারকারীকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে। বিএসএফ বা পুলিশের সহযোগিতা না থাকলে কোনো মাদকদ্রব্য ভারত থেকে বাংলাদেশে কখনোই প্রবেশ করতে পারত না। আমাদের সীমান্তে মাদক পাচারের বিরুদ্ধে বিজিবি যতই চেষ্টা করুক না কেন, যতদিন পর্যন্ত ভারতীয় প্রশাসন মাদক পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে না তুলবেন ততদিন পর্যন্ত এ সীমান্ত দিয়ে ফেন্সিডিল বা অন্যান্য মাদকদ্রব্যের চালান বন্ধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তারপরও বিজিবি তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
সর্বশেষ বুধবার ভোর রাতে শার্শা উপজেলার শালকোনা সীমান্ত থেকে ২৪ কেজি গাজাসহ তিন মাদক ব্যবসায়ীকে আটকের পর বেনাপোল সদর কোম্পানি ক্যাম্পে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিজিবির গত এক বছরের সাফল্যের কথা জানালেন যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সেলিম রেজা পিএসসি।
এ সময় তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারেন দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তের কতিপয় মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী বিভিন্ন কৌশলে ভারত থেকে মাদক এবং অস্ত্র এনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে বিক্রি করছে। সে সাথে স্বর্ণ ও হুন্ডির চালান পাঁচার করছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে এ ধরণের মাদক, অস্ত্র,
স্বর্ণ ও হুন্ডি পাঁচারকারীদের চিহ্নিত করে সীমান্ত এলাকায় গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাতে শার্শার শালকোনা সীমান্তে অভিযান চালিয়ে মেহেদী হাসান (১৯), রিয়াদ হোসেন (২২) ও সবুজ হোসেন (২৮) নামে তিন মাদক ব্যবসায়ীকে ২৪ কেজি গাঁজাসহ আটক করা
হয়।
গত সপ্তাহে বেনাপোলে রঘুনাথপুর সীমান্ত এলাকা ভারত থেকে পাচার হয়ে আসার পর ১১টি পিস্তল, ২২টি ম্যাগজিন, ৫০ রাউন্ড গুলি ও ২৪ কেজি গাঁজাসহ তিন চোরাকারবারীকে আটক করে বিজিবি।
বেনাপোল সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, এসময় সীমান্তের মাদক, অস্ত্র, স্বর্ণ ও হুন্ডি ব্যবসার সাথে জড়িত রাঘব বোয়ালরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়।
এ ব্যাপারে তিনি বলেন, রাঘব বোয়াল চোরাকারবারিরা সাধারণত মাদক, স্বর্ণ ও হুন্ডিসহ বিভিন্ন চোরাচালানী পণ্য নিজেরা বহন না করায় তাদেরকে হাতেনাতে আটক করা সম্ভব হয় না। যে কারণে বারবার তাদের চোরাচালানী সামগ্রী আটক হলেও তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। তাছাড়া একটা চোরাই পণ্য আটক হওয়ার পরে আমরা সেই আসামিকে থানায় দিয়ে দেই। থানা পুলিশ তদন্ত করে দেখেন এর সাথে আর কার কারা জড়িত আছেন। তদন্তের পর মূল আসামি কে বা রাঘব বোয়ালদের আটকের দায়-দায়িত্ব আসলে থানা পুলিশের