আদালতের দিকে তাকিয়ে জনির পরিবার
অনেক হুমকি-ধমকি পেরিয়ে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ হেফাজতে নিহত ইশতিয়াক হোসেন জনির পরিবার। আসামিরা পুলিশ সদস্য, রয়েছে পুলিশের সোর্সও। এ ছাড়াও মামলা চালানো থেকে বিরত থাকতে দেয়া হয়েছে নানা প্রলোভন। এসব হুমকি ধমকি, প্রলোভন উপেক্ষা করে বছরের পর বছর জনির পরিবার চালিয়ে গেছে আইনি লড়াই। অবশেষে রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেছেন আদালত। মিরপুরের পল্লবী থানায় পুলিশের নির্যাতনে নিহত জনি হত্যা মামলার রায় আজ। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে ২০১৪ সালের ৭ই আগস্ট এই মামলা দায়ের করেন জনির ছোট ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি। এই আইনে প্রথম কোনো মামলার রায় হচ্ছে।
এ বিষয়ে রকি বলেন, আদালতের দিকে তাকিয়ে আছি। অনেক হুমকি ধমকি, প্রলোভন উপেক্ষা করে আমরা বিচার চাচ্ছি। আশা করছি, খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। অন্তত পুলিশের পবিত্র পোশাক পরে আর কেউ এ ধরনের অপরাধ করার দুঃসাহস দেখাবে না, এমন একটি রায় চাই আমরা। চাঞ্চল্যকর এই মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা। তারা হচ্ছে, পল্লবী থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমান, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রাশেদুল ইসলাম ও এএসআই কামরুজ্জামান। আরো দুই আসামি হচ্ছে পুলিশের সোর্স সুমন ও রাসেল। আসামিদের মধ্যে এএসআই কামরুজ্জামান এবং সোর্স রাসেল পলাতক। আর কারাগারে রয়েছে এসআই জাহিদুর রহমান এবং সুমন। জামিনে আছেন এএসআই রাশেদুল ইসলাম।
মামলার বাদী রকি বলেন, মামলা দায়ের করার পর যতোদিন সকল আসামি কারাগারে ছিল ততোদিন আমার ও আমার পরিবারের কোনো সমস্যা হয়নি। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয়ার পর থেকে এএসআই রাশেদুল ও এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু আমাকে হুমকি ধমকি দেয়া শুরু করে। এমনকি নিহত জনির বাসায় গিয়েও মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয় এএসআই মিন্টু। এ ধরনের হুমকি ভিডিও ধারণ করেন রকি। থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। বিপুল অর্থের বিনিময়ে নিহত জনির পরিবারের সঙ্গে আপোষ করতে চেয়েছিলেন এসআই জাহিদের মা। প্রতিনিয়ত এরকম হুমকি ধমকির মধ্যে থাকলেও মামলা পরিচালনা থেকে সরে যাননি রকি।
রকি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমাদের টাকা নেই। ভালো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারিনি। বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়। পাঁচ বছর কেটে যায়। মামলাটির কার্যক্রম হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্থগিত করে দেয়। হাইকোর্টে মামলা চালাতে অনেক টাকার দরকার হয়। এই অবস্থায় নিরুপায় হয়ে যান নিহত জনির ছোট ভাই গাড়ি মেকার রকি। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)’র সহযোগিতা চান রকি। শেষ পর্যন্ত মামলা পরিচালনায় সহযোগিতার হাত বাড়ায় ব্লাস্ট। নিহত জনির মা খুরশিদা বেগম জানান, ছেলে রকির স্বল্প আয়ে কোনোভাবে সংসার চলছে। নিহত জনির দুই সন্তান রয়েছে। জনিকে হত্যা করার পর ওই সংসারের পুরো দায়িত্ব নেয় রকি। খুরশিদা বেগম বলেন, জনিকে ওরা মেরে ফেলেছে। সে আর ফিরবে না। কিন্তু আমি চাই না এভাবে আর কোনো মায়ের বুক খালি হোক। আর কোনো সন্তান এতিম হোক। এ জন্য খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবীর ইরানি ক্যাম্পে এক গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে পুলিশের সোর্স সুমন মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতে থাকে। এ সময় জনি ও রকি প্রতিবাদ করে। এতে সুমন ক্ষুব্ধ হয়। সে অনুষ্ঠানে মেয়েদের সঙ্গে বেপরোয়া আচরণ করতে থাকে। এ সময় ফোনে এসআই জাহিদকে ডেকে আনে সোর্স সুমন। এস আই জাহিদুর রহমান খান, এএসআই রাশেদুল ও এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টুসহ পুলিশের টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছেই তাণ্ডব শুরু করে। উপস্থিত নারী ও শিশুসহ সকলকে বেধড়ক মারধর করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেয়। অনুষ্ঠান থেকে জনি ও রকিসহ মোট আট জনকে আটক করা হয়। এ সময় এলাকাবাসী প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে এসআই জাহিদ। থানায় নিয়ে জনিকে পিলারের সঙ্গে বেঁধে পিটাতে থাকে এসআই জাহিদসহ মামলার অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা। জনিকে পেটাতে নিষেধ করলে রকিকেও নির্যাতন করা হয়। জনির অবস্থা খারাপ হলে তাকে মিরপুর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার আরো অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহত জনির মা খুরশিদা বেগম পল্লবী থানায় মামলা করতে গেলে তা গ্রহণ করা হয়নি। পরে জনির ভাই রকি সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরে ২০১৪ সালের ৭ই আগস্ট মহানগর দায়রা জজ আদালতে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা দায়ের করেন।