ভারতের সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার ইচ্ছা কিংবা ক্ষমতা কোনটাই হাসিনার নেই

0

মাহমুদুর রহমান

মাস দেড়েক আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অনেকটা আকস্মিকভাবেই শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেছিলেন। এ ধরনের ফোনে আলাপ বিভিন্ন দেশের সরকার অথবা রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে হরহামেশাই হয়ে থাকে। সেগুলোর খবর সব সময় মিডিয়াতে প্রকাশও হয় না। কিন্তু আওয়ামী সরকারের আমলে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এমনই সাপেনেউলে থাকে যে ইমরানের এক ফোনের চর্চা এখনও চলছে। সম্ভবত চীনের চাপে বাধ্য হয়ে অনেক চেষ্টাচরিত্র করে ফোন করলো ইমরান খান আর ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সেখানে হাসিনার পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এই জাতীয় বিশ্লেষণ ইতিহাস বিমুখতার ফসল বলেই আমি মনে করি। অথচ শেখ হাসিনা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে দু-তিন দিন অপেক্ষায় রেখে তবেই ফোন ধরেছেন। এর আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে হাসিনার দিল্লি সফরের ঠিক এক দিন আগে ইমরান এ রকম ফোন করেছিলেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী শেখ হাসিনা কখনো ইমরান খানকে পাল্টা ফোন করেছেন এমন কোন সংবাদ আমার চোখে কখনো পড়েনি। মোদী-হাসিনা সম্পর্কের টানাপোড়েন আবিষ্কারের অতি উৎসাহে বিশ্লেষকরা এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে খানিকটা ইতিহাস চর্চা করা যাক।

১৯৭৫ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাত্র কয়েকজন মধ্যম পর্যায়ের সাহসী মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশপ্রেমিক কর্মকর্তার নেতৃত্বে পরিচালিত এক সামরিক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের পতন ঘটেছিল। সেই অভ্যুত্থানে একনায়ক রাষ্ট্রপ্রধানের বিদেশে অবস্থানরত দুই কন্যা ব্যতীত পরিবারের আর সবাই নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। সেই দুই কন্যা পরবর্তী ছয় বছর দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মরহুম মুজিবের বড় কন্যার স্বামীকে ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশনে চাকরিও দিয়েছিলেন। সেই কন্যাই বাংলাদেশের বর্তমান ফ্যাসিস্ট শাসক। শেখ হাসিনা সর্বদা ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি ব্যক্তিগতভাবে এবং ভারতের প্রতি সামগ্রিকভাবে কৃতজ্ঞ থেকেছেন। গত বার বছরের একটানা রাজত্বকালে বারবার প্রমাণ করেছেন যে তার কাছে বাংলাদেশের স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থ অনেক উপরে।

শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে দাবী করেছেন যে তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন সেটা বাংলাদেশের কোন সরকার দিতে পারত না। তার দাবীর সারবত্তা আছে। তিনি বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতের এক অংশ থেকে অপর অংশে মানুষ এবং সর্বপ্রকার মালামাল বিনা শুল্কে পারাপার করার একচ্ছত্র অধিকার দিয়েছেন, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে বাংলাদেশের উপরে ভারতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, সামরিক স্থাপনাসহ সমগ্র বাংলাদেশকে ভারতীয় গোয়েন্দাদের অবাধ চারণভূমিতে পরিণত করেছেন, বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা আসামের বিপ্লবীদের ধরে ধরে ভারতের হাতে সমর্পণ করেছেন, তথাকথিত ইসলামী চরমপন্থি নির্মূলের নামে ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা মুসলমানদের বিনা বিচারে হত্যা এবং গুম করেছেন, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় সংখ্যালঘু এবং ভারতপন্থীদের বসিয়েছেন, ভারতে মুসলমানদের উপর মোদী-বাহিনীর অব্যাহত অমানবিক নির্যাতনের কোন প্রতিবাদ পর্যন্ত ৯০ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে হতে দেননি। প্রতিদানে ভারতও হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছে। এ ব্যাপারে ২০১৪ সালের কংগ্রেস কিংবা ২০১৮ সালের বিজেপি সরকারের নীতির মধ্যে কোন ফারাক দেখা যায়নি। একদলীয় নির্বাচনী তামাশাই হোক কিংবা নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশ-র‌্যাব দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করাই হোক, হাসিনার সকল অপকর্মে দিল্লি পাশে থেকেছে। হাসিনার ব্রিফ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এবং মন্ত্রী ওয়াশিংটন এবং অন্যান্য পশ্চিমা রাজধানীতে ছোটাছুটি করেছেন। ২০১৪ সালে একদলীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে সুজাতা সিংহের ঢাকায় এসে জেনারেল এরশাদকে ধমকে যাওয়া এবং ডিজিএফআই প্রধানকে দিয়ে তাকে ক্যান্টনমেন্টে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কোন কারণ নেই। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বর্ণনায় স্বামী-স্ত্রী এবং রক্তের সম্পর্কের মধ্যে হঠাৎ এমন কি ঘটলো যে ভারতের এক শ্রেণির মিডিয়াতে টানাপোড়েন অথবা শীতলতার গল্প ফাঁদা হচ্ছে!

বিগত বারো বছরের একটানা শাসনকালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সকল ক্ষমতা তার একক হাতে সংহত করে উত্তর কোরিয়ার আদলে এক ভয়ংকর একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে সক্ষম হয়েছেন। পুলিশকে দলীয় ঠ্যাঙ্গারে বাহিনীর মত নিষ্ঠুরভাবে জনগণের বিপক্ষে লেলিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিযোগীদের নির্মূল, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ এবং সুশীল সমাজকে নীরব করে দেয়া হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে শাসক এবং রাষ্ট্র যেভাবে সমার্থক হয়ে ওঠে বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ফলে বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় শেখ হাসিনার বিকল্প এখন আর কাউকে ভাবতে পারছে না। সেই বিবেচনা থেকেই ভারতের সঙ্গে হাসিনার বিশেষ সম্পর্কের কথা জানা সত্ত্বেও চীন অর্থনৈতিক কূটনীতির কৌশলে সেই তাকেই নেপালের মত দিল্লির প্রভাব বলয় থেকে সরানোর চেষ্টা করছে। চীন সেই প্রচেষ্টায় সফল হবে কিনা সেটা ভবিষ্যতের ব্যাপার। এনিয়ে পরে কোন এক সময় লেখার ইচ্ছে রয়েছে।

শেখ হাসিনা চীনের টাকায় অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলে ভারতও তার সুফল থেকে কোন অংশে বঞ্চিত হবে না। বাংলাদেশ কেবল ভারতীয় পণ্যের বিশাল বাজারই নয়, বাংলাদেশীরা বিপুল সংখ্যায় ভারত থেকে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা-সেবা গ্রহণ করে থাকে। অতএব, চীনা বিনিয়োগের ফলে বাংলাদেশের মানুষের আয় বৃদ্ধি পেলে ভারতের তাতে কোন ক্ষতি নেই যতক্ষণ পর্যন্ত শেখ হাসিনার উপর দিল্লির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বজায় থাকে। ভারতীয় মিডিয়ার সাম্প্রতিক প্রচারণা সে দেশের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের আলোকেই বিচার করতে হবে। এই প্রচারণা শেখ হাসিনা এবং ভারত উভয়ের জন্যই লাভজনক।

বাংলাদেশের সিংহভাগ সাধারণ জনগণ ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী মনোভাব পোষণ করে থাকে। সেদেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি দিল্লির ক্ষমতাসীন ইসলামবিদ্বেষী, কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের অত্যাচার বাংলাদেশের মুসলমানদের অধিকতর ভারতবিরোধী করেছে। শেখ হাসিনা সেই ভারতের কাছেই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়েছেন। ফলে তিনি চরমভাবে অজনপ্রিয় হয়েছেন। শেখ হাসিনা বিষয়টি জানেন বলেই নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সহায়তাক্রমে ক্ষমতায় টিকে আছেন। জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে হলে তার ভারতবিরোধী ভাবমূর্তি বিশেষ প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত চীনের অধিকতর কৃপাদৃষ্টি পাওয়ার জন্যও ভারত বিরোধিতার প্রচারণা সহায়ক হবে এবং চীন আরও খুশি হয়ে অধিক পরিমাণে বাংলাদেশ সরকারকে অর্থ দেবে। অপরদিকে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে টানাপোড়েনের মিথ্যা প্রচারণার আড়ালে দিল্লি বাংলাদেশের উপর তার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হবে। এর চেয়ে উইন-উইন পরিস্থিতি আর কী হতে পারে! ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ তথ্য অনুযায়ী ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব শেষোক্ত উদ্দেশেই সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। একই কারণে ইমরান খানের এক গুরুত্বহীন টেলিফোন নিয়ে মিডিয়াতে ধুম্রজাল সৃষ্টি করে জনগণ এবং চীনকে বোকা বানানো হচ্ছে।

১৯৪৯ সালে সম্পাদিত অনন্তকাল মেয়াদি এক চুক্তির মাধ্যমে ভারত ভুটানকে যেভাবে আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করে রেখেছে বাংলাদেশ নিয়েও ইন্দিরা গান্ধীর একইরকম পরিকল্পনা ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশী সরকারকে দিয়ে যে সাত দফা চুক্তিতে সই করানো হয়েছিল, আন্তর্জাতিক চাপের কারণে ভারতের পক্ষে সেটি পরবর্তীতে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৭২ সালে ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ১৯৯৭ সালে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বাংলাদেশের জনগণের তীব্র বিরোধিতার কারণে চুক্তি নবায়ন করাও আর সম্ভব হয়নি। তবে প্রকাশ্যে এই চুক্তি নবায়ন না করা হলেও গত বারো বছরে চুক্তির বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অংশের অধিকাংশই প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সর্বশেষ যে চুক্তি সম্পাদিত হতে যাচ্ছে সেটা করা হলে বাংলাদেশের আর কোন স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি থাকবে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে যে, ভুটানের মত করেই কোন তৃতীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যে কোন চুক্তি সম্পাদনের আগে দিল্লি থেকে পূর্বানুমতি নিতে হবে। ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আর্টিকেল ৪ এর আলোকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে ছিটেফোঁটা এখনো অবশিষ্ট আছে সেটাও হরণ করার আয়োজন চলছে। সেই আর্টিকেলে বলা আছে, “উভয় রাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সমস্যা প্রসঙ্গে নিয়মিত মিটিংয়ের মাধ্যমে সর্ব পর্যায়ে যোগাযোগ রেখে পরামর্শ করা হবে”। অর্থাৎ ভারতের নির্দেশ মোতাবেক বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চলবে। সূত্র অনুযায়ী হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সফরে সেই চুক্তি নিয়েই প্রধানত আলোচনা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে যে দ্রুততার সাথে চুক্তি বাস্তবায়ন-কল্পে শীঘ্রই একটি যৌথ পরামর্শক কমিটি তৈরি করা হবে।

বাস্তবতা হল ভারতের সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার ইচ্ছা কিংবা ক্ষমতা কোনটাই হাসিনার নেই। ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফসলরূপে এক এগারোর সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব এবং জনগণ সাংবিধানিক অধিকার হারিয়েছে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং শেখ হাসিনার একান্ত আপনজন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের করোনায় মৃত্যুর পর বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শাসকের শোক পালনের ঘটা থেকে আশা যে, শেখ হাসিনার মধ্যে আকস্মিক ভারত বিরোধিতার গন্ধ খুঁজে বেড়ানো বিশেষজ্ঞদের হুঁশ ফিরেছে। বাংলাদেশের মানুষ কেন যেন বুঝতে চায় না যে, শেখ হাসিনা হিন্দুত্ববাদের কাছে নিজেকে সর্বোতভাবে সমর্পণ করেছেন। তার আর নূতন কোন ঘাটে নৌকা বাঁধার সুযোগ নেই। অতএব, জীবন বাজি রেখে ফ্যাসিস্ট সরকার এবং ভারতীয় সম্প্রসারণ-বাদের প্রতিরোধে রাজপথে নামতে না পারলে দেশের লুট হওয়া সার্বভৌমত্ব কিংবা হারানো অধিকার কোনটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

লেখক: সম্পাদক, আমারদেশ

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com